পাতা:মাধবীকঙ্কণ - রমেশচন্দ্র দত্ত.pdf/৫৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
“আক রা ঝোপ, কোক রা বার,
বাজরা রা রোটি, মোঠ রা সার,
দেখো হো রাজা তেরি মাড়ওয়ার।”

 মাড়ওয়ারিগণ সগর্বে উত্তর করিল, “আমাদের জন্মভূমি উর্বরা নহে, কিন্তু বীর প্রসবিনী বটে।” প্রকৃত মাড়ওয়ারের রাজপুতেরা কঠোর জাতি, রাজপুতানায় তাহাদের অপেক্ষা সাহসী জাতি আর ছিল না।

 সৈন্যগণ এইরূপে কয়েকদিন ভ্রমণ করিতে করিতে রাজধানী যোধপুরের সম্মুখে পৌঁছিল ও শিবির সন্নিবেশিত করিল। তখন নরেন্দ্র স্বীয় বন্ধু গজপতির কথা স্মরণ করিয়া একবার রাজার সহিত সাক্ষাৎ করিতে গেলেন। রাজা যশোবন্তসিংহ শিবিরে একাকী বিষণ্ণবদনে বসিয়া আছেন, নরেন্দ্র তাঁহার নিকট যাইয়া পৌঁছিলেন।

 রাজার আদেশ পাইয়া নরেন্দ্র কহিলেন, “মহারাজ। সিপ্রাতীরে আপনার একজন অনুচর হত হইয়াছেন। পূর্বে একবার মহারাজ তাঁহার প্রতি প্রসন্ন হইয়া এই মুক্তামালা তাঁহাকে প্রদান করিয়াছিলেন তিনিও আপনার দানের অপমান করেন নাই, সম্মুখযুদ্ধে হত হইয়াছেন। মৃত্যর পূর্বে গজপতিসিংহ এ মুক্তামালা আপনার হস্তে প্রত্যর্পণ করিতে তাঁকে আদেশ দিয়া গিয়াছেন।”

 রাজা সেই মুক্তামালা ক্ষণেক নিরীক্ষণ করিয়া দীর্ঘনিঃশ্বাস পরিত্যাগ করিয়া বলিলেন,—“হা গজপতি! মাড়ওয়ারে তোমা অপেক্ষা সাহসী যোদ্ধা কেহ ছিল না। তোমার পিতা তেজসিংহকে আমি জানিতাম, সূর্যমহল-দুর্গে তাঁহার আতিথ্য গ্রহণ করিয়াছিলাম। গজপতি! তুমি আমারই অনুরোধে মাড়ওয়ারে আসিয়াছিলে, বারবার যুদ্ধে পৈতৃক বিক্রম দেখাইয়াছ। একবার যুদ্ধে আমার জীবন রক্ষা করিয়াছিলে, সেইজন্য তোমাকে মুক্তামালা দিয়াছিলাম, এবার আপনার জীবন আমার জন্য বিসর্জন দিয়া সেই মালা ফিরাইয়া দিলে। বৎস, নদীর জল একবার যাইলে আর ফিরিয়া আসে না, রাজা একবার দান করিলে আর ফিরিয়া লন না। তোমার বন্ধুর মুক্তামালা, তুমি ললাটে ধারণ করিও এবং যুদ্ধের সময় তাঁহার বীরত্ব যেন তোমার স্মরণ থাকে।”

 নরেন্দ্র রাজাকে শত শত ধন্যবাদ দিয়া সেই মালা শিরে ধারণ করিয়া কহিলেন, “মহারাজ, আমার একটি আবেদন আছে। গজপতির দুইটি শিশু-সন্তান আছে, তাহাদের মাতা নাই। গজপতি মহারাজকে বলিয়াছেন, যে অনুগ্রহ করিয়া তাহাদের প্রতি কৃপাদৃষ্টি করেন যেন কালে শিশু রঘুনাথও রাজাজ্ঞায় পিতার ন্যায় সংগ্রামে জীবন দিতে সক্ষম হয়। ইহা অপেক্ষা অধিক মঙ্গলকামনা তাহার পিতাও জানে না।”

 এই করুণ বাক্য শুনিয়া রাজার নয়নে জল আসিল। তিনি বলিলেন বৎস, ক্ষান্ত

৫৫