পাতা:মাধবীকঙ্কণ - রমেশচন্দ্র দত্ত.pdf/৫৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

এ নয়ন যশোবন্তসিংহকে আর দেখিবে না। আমি মেওয়ারের রাণার দুহিতা। প্রতাপসিংহের কুলে যিনি বিবাহ করেন, তিনি ভীরু কাপুরুষ কেন হইবেন? যুদ্ধে জয় করিতে পারিলেন না, কেন সম্মুখরণে হত হইলেন না? দূতগণ। এখনও দণ্ডায়মান আছে? আমার যোদ্ধাগণ কোথায়? দূতগণকে পর্বতের উপর হতে নীচে নিক্ষেপ কর, দ্বার রুদ্ধ কর।”

 রাজ্ঞীর সমস্ত শরীর কম্পিত হইতেছিল, ক্রোধে কণ্ঠ রুদ্ধ হইল, মুখমণ্ডল রক্তবর্ণ হইয়া উঠিল। তখন নরেন্দ্র অগ্রসর হইয়া ধীরে ধীরে অতিশয় গম্ভীর স্বরে উত্তর করিলেন, “মহারাজ্ঞী, আমাদের মৃত্যুর আদেশ দিয়াছেন, আমরা মৃত্যুভয় করি না, কিন্তু মহারাজা যশোবন্তসিংহকে কাপুরুষ বলিবেন না। এই নয়নে তাঁহাকে যুদ্ধ করিতে দেখিয়াছি, যতদিন জীবিত থাকিব, সেরূপ ভয়ঙ্কর যুদ্ধ কখনও দেখিব না, সেরূপ অদ্বিতীয় বীর কখনও দেখিব না।”

 রাজ্ঞী ক্ষণেক স্থির-নয়নে নরেন্দ্রের দিকে চাহিয়া রহিলেন, পরে ধীরে ধীরে বলিলেন,—যথার্থই কি যশোবন্ত সিংহ সম্মুখযুদ্ধ করিয়াছিলেন? তুমি বিদেশীয়, তোমার জীবনের কোন ভয় নাই, যথার্থ কথা বিস্তার করিয়া বল।”

 নরেন্দ্র যুদ্ধের বিষয় সবিশেষ বর্ণনা করিলেন। রাজপুত-সৈন্যের যেরূপ সাহস দেখিয়াছিলেন, মহারাজের যেরূপ সাহস দেখিয়াছিলেন তাহা বলিলেন—“যখন মেঘরাশির ন্যায় চারিদিকে মোগল-সেনা আসিয়া বেষ্টন করিল, যখন ধূম ও ধূলায় যুদ্ধক্ষেত্র অন্ধকার হইয়া গেল, কখন ভীরু কাসেম খা পলায়ন করিল, তখনও মহারাজ রাজপুতের উচিত সাহস অবলম্বন করিয়া যুদ্ধ করিতে লাগিলেন। চারিদিকে রাজপুতশোণিত পর্বত উপত্যকা ও সিপ্রা নদী আরক্ত হইযাছে, রাজার চতুর্দিকে অল্পসংখ্যক মাত্র রাজপুত আছে, আওরংজীব ও মোরাদ সহস্র মোগল-সৈন্যের সহিত রাজার উপর আক্রমণ করিতেছেন, তখনও মহারাজ যশবন্ত সাহস অবলম্বন করিয়া যুদ্ধ করিতে লাগিলেন। রাজার পদতলে শত শত রাজপুত হত হইতে লাগিল, রাজপুতসংখ্যা ক্ষীণ হইতে লাগিল, মোগলের জয়নাদে মেদিনী ও আকাশ কম্পিত হইতে লাগিল, কিন্তু মহারাজের হৃদয় কম্পিত হইল না। অষ্ট সহস্র রাজপুতের মধ্যে অষ্ট শতও জীবিত ছিল না, তথাপি মহারাজ যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করিলেন না। কল্লোলিনী সিপ্রানদী ও ভীষণ বিন্ধ্য-পর্বত রাজা যশোবন্তের বীরত্বের সাক্ষী আছে।”

 শুনিতে শুনিতে রাজ্ঞীর নয়নদ্বয় জলে ছল-ছল করিতে লাগিল, তিনি বলিলেন,— “ভগবান। তোমাকে নমস্কার করি, আমার যশোবন্ত রাজপুতের নাম রাখিয়াছেন। বিদেশীয় দূত, এ কথায় আমার হৃদয় শীতল হইল। বল, ইহার পর কি হইল?”

৫৭