পাতা:মাধবীকঙ্কণ - রমেশচন্দ্র দত্ত.pdf/৫৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 নরেন্দ্র। মানুষের যাহা সাধ্য, রাজপুতের যাহা সাধ্য, যশোবন্ত তাহা করিয়াছেন। যখন কেবলমাত্র পঞ্চ শত সৈন্য জীবিত আছে দেখিলেন, তখন রাজা যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করিলেন।

 রাজ্ঞী। “পলায়ন করিলেন, হা বিধাতা! রাণার জামাতা পলায়ন করিলেন।” —বক্ষস্থলে করাঘাত করিয়া রাজ্ঞী পুনরায় মূর্ছিতা হইয়া পড়িলেন।

 তৎক্ষণাৎ দাসীগণ রাজ্ঞীর মুখে জল সিঞ্চন করিতে লাগিল। রাজ্ঞীও অল্পমধ্যেই চেতনাপ্রাপ্ত হইয়া এবার করুণস্বরে বলিলেন—“সহচরি! চিতা প্রস্তুত কর, আমার স্বামী যুদ্ধক্ষেত্রে হত হইয়াছেন, তিনি স্বর্গধামে আমার জন্য অপেক্ষা করিতেছেন, আমি তথায় যাই! যশোবন্তের নামে যে আসিয়াছে সে প্রবঞ্চক। আর তুই দূত, তোর সঙ্গীগণের সহিত এইক্ষণেই মাড়ওয়ার দেশ হইতে নিষ্ক্রান্ত হ, নচেৎ প্রাণদণ্ড হইবে।”

 নরেন্দ্র ও দূতগণ দুর্গ হইতে নিষ্ক্রান্ত হইলেন, রাজ্ঞীয় আজ্ঞায় দুর্গের দ্বার রুদ্ধ হইল। বাহিরে যাইবার সমর যোধপুরের রাজমন্ত্রী দূতের হস্তে একখানি পত্র দিয়া বলিলেন, “মহারাজের সহিত তোমাদের দেখা করিবার আবশ্যকও নাই, এই পত্র লইয়া শীঘ্র মেওয়ার দেশের রাজধানী উদয়পুরে যাও। তথায় রাণা রাজসিংহকে এই পত্র দিও, তিনি তোমাদিগকে আশ্রয় দিবেন। আমাদের মহারাজ্ঞীর আজ্ঞা অলঙ্ঘনীয়, মাড়ওয়ারে আর থাকিতে পাইবে না। মহারাজ্ঞীর মাতা তথায় আছেন, পত্রপ্রাপ্তি মাত্র তিনি যোধপুরে আসিবেন, তিনি ভিন্ন তাঁহার কন্যাকে আর কেহ সান্ত্বনা করিতে পারিবেন না।”

 ইতিহাসে লিখিত আছে যে, যোধপুরের রাজ্ঞী আট নয় দিবস অবধি উন্মত্তপ্রায় হইয়া রহিলেন। পরে উদয়পুর হইতে তাঁহার মাতা আসিয়া তাঁহাকে সান্ত্বনা করিলে তখন তিনি যশোবন্তের সহিত সাক্ষাৎ করিতে সম্মত হইলেন। পুনরায় সৈন্য সংগ্রহ করিয়া যশোবন্ত আওরংজীবের সহিত অচিরাৎ যুদ্ধ করিতে যাইবেন স্থির হইল।

কুড়ি

 মেওয়ার দেশে পূর্বে চিতোর প্রধান নগরী ছিল, এক্ষণে উদয়পুর মাড়ওয়ারের বালুকারাশি ও মরুভূমি হইতে প্রধান-পর্বত মেওয়ার দেশে পুনরায় আসিতে নরেন্দ্রনাথ বড়ই আনন্দানুভব করিলেন। আবার আরাবলীর উচ্চ শিখর উল্লঙ্ঘন করিলেন, আবার পর্বতীয় নদী ও প্রস্রবণের বেগ ও মহিমা সন্দর্শন করিলেন, আবার শান্ত নিস্তব্ধ পর্বত হ্রদের শোভা দেখিয়া নরেন্দ্রের হৃদয়ে অতুল আনন্দোদয় হইল। কিছুদিন এইরূপে ভ্রমণ করিয়া নরেন্দ্রনাথ ও যোধপুরের দূতগণ উদয়পুরে উপস্থিত হইলেন।

৫৮