পাতা:মাধবীকঙ্কণ - রমেশচন্দ্র দত্ত.pdf/৫৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 নরেন্দ্রনাথের বোধ হইল, সেরূপ সুন্দর স্থানে সেরূপ সুন্দর নগরী পূর্বে তিনি কখনও দেখেন নাই। নীচে সুন্দর শান্ত হ্রদ, নির্মল আকাশ ও চতুর্দিকস্থ পর্বতশ্রেণীর ছায়া সযত্নে বক্ষে ধারণ করিতেছে। চতুর্দিকে সুন্দর পর্বতরাশির পর পর্বতরাশি যেন প্রকৃতি এই মনোহর উচ্চ প্রাচীর দিয়া এই সুখের আবাসস্থানকে রক্ষা করিতেছে। হ্রদের নিকটবর্তী একটি পর্বতশ্রেণীর উপর সুন্দর রাজপ্রাসাদ ও শ্বেতবর্ণ সৌধমালা যেন সহাস্যবদনে নিম্ন দর্পণে আপনার সুন্দর প্রতিরূপ অবলোকন করিতেছে।

 সূর্যদ্বার দিয়া যোধপুরের দূত নগরে প্রবেশ করিলেন: যোধপুর ও উদয়পুরে তখন বন্ধুত্ব ছিল, সুতরাং যোধপুরের দূতগণকে আহ্বান করিবার জন্য নাগরিকগণ জয়ধ্বনি করিতে লাগিল। প্রশস্ত পথ দিয়া নরেন্দ্রনাথ ও তাহার সঙ্গিগণ রাজপ্রাসাদাভিমুখে যাইতে লাগিলেন, চারণগণ “টপ্পা” অর্থাৎ মঙ্গলসূচক গীত গাইতে লাগিলেন, দুই পাশে স্ত্রীলোকগণ কলসকক্ষে দণ্ডায়মান হইয়া “সুহেলিয়া” অর্থাৎ আনন্দগীত গাইয়া যোধপুরের দূতদিগকে আহ্বান করিলেন। দূতগণ সকলেই দুই-এক মুদ্রা পুরস্কার দিয়া পরিতুষ্ট করিলেন।

 অনন্তর সকলে রাজপ্রাসাদে পৌঁছিয়া রাণার অনুমতিক্রমে প্রাসাদের উপর উঠিলেন, শ্বেতপ্রস্তর-নির্মিত সোপান দ্বারা আরোহণ করিয়া সূর্যমহলে প্রবেশ করিলেন। সেই মহলেই রাণা বিদেশীয় দূতদিগকে আহ্বান করিতেন। বংশের আদিপুরুষ সুর্যের একটি প্রতিমূর্তি সেই গৃহের এক দেওয়ালে খোদিত ছিল, সেইজন্য উক্ত মহলের নাম সূর্যমহল।

 বক্তবর্ণ বস্ত্রমণ্ডিত বহুমূল্য রত্ন-বিনির্মিত রাজাসনে বাপ্পারাওয়ের বংশাবতংস মহারাণা রাজসিংহ উপবেশন করিয়া আছেন। চারিদিকে সুবর্ণখচিত রৌপ্যস্তম্ভের উপর একটি চন্দ্রাতপ মণিমুক্তায় ঝলমল্ করিতেছে। কিঞ্চিৎ দূরে পারিষদগণ উপবেশন করিয়া আছেন ও চারণগণ স্তুতিবাক্যে এই অমরাবতী তুল্য রাজসভায় রাণার সাধুবাদ করিতেছেন। এরূপ সময়ে যোধপুরের দূত প্রবেশ করিলেন।

 দূত বিনীতভাবে সমস্ত সমাচার অবগত করালেন। যশোবন্তসিংহের পরাজয় ও দেশে প্রত্যাগমন, মহারাজ্ঞীর ক্রোধ ও রাজার দুর্দশা এই সমস্ত অবগত করাইয়া যোধপুরের মন্ত্রীর পত্র রাণার হস্তে সমর্পণ করিলেন। রাণা রাজসিংহ সমস্ত বিষয় অবগত হইয়া যশোবন্তের জন্য শোক প্রকাশ করিয়া দূতগণকে বিদায় করিলেন ও তাঁহাদের উদয়পুরে থাকিবার জন্য উপযুক্ত স্থান নির্ধারিত করিতে মন্ত্রিবরকে আদেশ করিলেন। অল্পদিন পরেই যোধপুররাজ্ঞীর মাতা উদয়পুর হইতে যোধপুরে গমন করিলেন।

 নরেন্দ্রনাথ উদয়পুরে কয়েক মাস বাস করিয়া প্রীতিলাভ করিলেন। হেমের প্রতিমূর্তি তাঁহার হৃদয়ে অনপনেয় অঙ্কে অঙ্কিত হইয়াছিল, হেমের চিন্তা তিরোহিত হইবার নহে,

৫৯