পাতা:মাধবীকঙ্কণ - রমেশচন্দ্র দত্ত.pdf/৬২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

সহস্র সহস্র নগরবাসীদিগের সমাগম ও রাজভক্তি দৃষ্টি করিয়াছে, প্রাচীন নিয়ম অনুসারে স্বাধীন রাজপুতদিগের শরৎকালের আনন্দোৎসব দেখিয়া নয়ন তৃপ্ত করিয়াছে।

 সমস্ত দিন এইরূপ উৎসব দেখিয়া নরেন্দ্রনাথ সন্ধ্যার সময় একটি বৃক্ষতলে যাইয়া কিছু ফলমূল আহারের আয়োজন করিলেন এবং নিকটস্থ একটি কূপ হইতে জল আনিতে গেলেন। কূপের নিকট গোস্বামীবেশে এক ব্যক্তি দণ্ডায়মান ছিলেন, তিনিও জল আনিতে গিয়াছিলেন। তিনি নরেন্দ্রকে কিঞ্চিৎ পুরুষ ভাবে ঠেলিয়া দিয়া আগে নিজে জল তুলিতে লাগিলেন।

 গোস্বামীর এই অভদ্রাচরণ দেখিয়া নরেন্দ্র ক্রুদ্ধ হইলেন এবং তিরস্কার করিলেন। গোস্বামী দ্বিগুণ কটূভাষায় তিরস্কার করিয়া বলিলেন,—“তুমি বিদেশীয়, রাজস্থানে আসিয়া রাজপুতদিগের সহিত কলহ করিতে তোমার ভয় বোধ হয় না?”

 নরেন্দ্র। আমি বিদেশীয় বটে, কিন্তু বহুকাল অবধি রাজপুতদিগের সহিত বসবাস করিয়াছি; তোমার ন্যায় অভদ্র রাজপুত দেখি নাই।

 গোস্বামী। যদি রাজপুতদিগের সহিত সহবাস করিয়া থাক তাহা হইলে বোধ হয় জান যে রাজপুতমাত্রেই অসি ও ঢাল চালাইতে জানে; অতএব চুপ করিয়া থাক।

 নরেন্দ্র। গর্বিত রাজপুত, আমিও অসি ও ঢাল চালনা কিছু শিক্ষা করিয়াছি, আমার নিকট গর্ব করিও না। তুমি গোস্বামী বলিয়া এবার ক্ষমা করিলাম।

 কথায় কথায় বিবাদ বাড়িতে লাগিল, গোস্বামী অতিশয় ক্রুদ্ধ হইয়া নরেন্দ্রকে প্রহার করিলেন, নরেন্দ্রও প্রহার করিলেন, অল্পক্ষণে উভয়েই জ্ঞানশূন্য হইয়া অসি ঢাল বাহির করিলেন। তখন অন্ধকার হইয়াছে, সেস্থান নির্জন আর সকলে চলিয়া গিয়াছে।

 দুইজনে একেবারে বেগে যুদ্ধ আরম্ভ করিলেন, ক্ষণকাল তাঁহাদের কাহাকেও ভাল করিয়া দেখা গেল না। মুহূর্তমধ্যে নরেন্দ্র পরাজিত হইলেন। সেই অপূর্ব বলবান গোস্বামীর প্রচণ্ড আঘাতে নরেন্দ্রের ঢাল চূর্ণ হইয়া গেল, নরেন্দ্রের অসি হস্ত হইতে পড়িয়া গেল, নরেন্দ্র স্বয়ং ভূমিতে নিপতিত হইলেন। তীব্রস্বরে গোস্বামী বলিলেন,—“বিদেশীয় যোদ্ধা! তুমি বালক, তোমার অপরাধ ক্ষমা করিলাম। পুনরায় রাজপুত গোস্বামীর সহিত কলহ করিও না, গোস্বামীর চিরজীবন কেবল পূজাকার্যে অতিবাহিত হয় নাই, সে-ও যুদ্ধ-ব্যবসার কিছু কিছু জানে।”

 নরেন্দ্র কর্কশস্বরে বলিলেন,—“রাজপুত! আমি তোমার নিকট জীবন-ভিক্ষা চাহি না। তোমার যাহা ইচ্ছা, যাহা সাধ্য কর, আমি অনুগ্রহ চাহি না।”

 গোস্বামী তথন গম্ভীর স্বরে উত্তর করিলেন,—“যোদ্ধা আমিও যুদ্ধ-ব্যবসায় করিয়া

৬২