পাতা:মাধবীকঙ্কণ - রমেশচন্দ্র দত্ত.pdf/৭৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

সুন্দর কুঞ্জবন, সুন্দর ফোয়ারা; পাশে শ্যামা যমুনা। আগ্রার প্রকাণ্ড দুর্গ; তন্মধ্যে মর্মর-প্রস্তর-বিনির্মিত সুন্দর মতি-মসজিদ, দেওয়ান-খাস, দেওয়ান-আম, রংমহল, শীসমহল। আগ্রার সৌন্দর্য কত বর্ণনা করিব পাঠকগণ! যদি এই অপূর্ব নগর না দেখিয়া থাকেন, অদ্যই যাইবার উদ্যোগ করুন। ‘তিনি’ ব্যয়ের ওজন করিবেন, তাহা শুনিবেন না, আপনাদিগের অনুরোধ অলঙ্ঘনীয়, আপনাদিগের অশ্রুজলে সকল আপত্তি ভাসিয়া যাইবে।

 প্রসিদ্ধ ময়ূর-সিংহাসনে অদ্য সম্রাট আওরংজীব উপবেশন করিয়াছেন। প্রাসাদেও শ্বেত-স্তম্ভরাশি বড় শোভা পাইতেছে। রক্তবর্ণ চন্দ্রাতপ হইতে পুষ্পমাল্যের সহিত মণি-মাণিক্য ঝুলিতেছে ও প্রাতঃকালের আলোকস্পর্শে অপূর্ব শোভা ধারণ করিয়াছে। চারিদিকে মহারাজা, রাজা, ওমরাহ, মনসবদার প্রভৃতি ভারতের অগ্রগণ্য বীর, ধনী ও মান্য লোকে অদ্য রাজপ্রাসাদকে ইন্দ্রপুরী করিয়াছে।

 সেই প্রাসাদের সম্মুখে বিস্তৃত শিবির সন্নিবেশিত হইয়াছে, শিবিবের চতুর্দিকে রৌপ্য-বিনির্মিত স্তম্ভ ঝকমক্ করিতেছে। উপরের অস্ত্র উজ্জ্বল রক্তবর্ণ, ভিতরে মসলীপত্তনের ছিট, সেই ছিটে লতা-পুষ্প এরূপ সুন্দর বিচিত্র হইয়াছে যে, শিবিরের পার্শ্বে যথার্থ পুষ্প ফুটিয়াছে, দর্শকদিগের এরূপ ভ্রম হয়। ভূমিতে অপরূপ গালিচা, তাহাতেও পুষ্পগুলি এরূপ সুন্দরভাবে বুনা হইয়াছে যে, শিবিরস্থ ব্যক্তি পূষ্প দলিত হইবে ভয়ে সহসা পদক্ষেপ করিতে সঙ্কোচ করেন।

 তাহার বাহিরে দুর্গের প্রাচীর পর্যন্ত জয়পতাকা ও পুষ্পপত্র দ্বারা দুর্গ সুশোভিত হইয়াছে। সেনাগণ শ্রেণীবদ্ধ হইয়া বিজয়বাদ্যে সকলের মন উত্তেজিত করিতেছে, নবজাত সূর্যরশ্মিতে তাহাদের বন্দুক ঝকমক্ করিতেছে। দুর্গপ্রাচীরের ওপর, ইংরেজ, ফরাসী ও ওলন্দাজ সৈনিকগণ ঘন ঘন কামান ছাড়িতেছে। তাহারা বহুদূর হইতে রত্নগর্ভ ভারতবর্ষে রত্ন কুড়াইবার জন্যে আসিয়াছে ও ‘সম্রাটের বেতনভোগী’ হইয়া অদ্য কামানের শব্দে সম্রাটের বিজয় প্রচার করিতেছে। দুর্গের বাহিরে নগরের পথে, ঘাটে, গৃহে, দ্বারে ও যমুনাতীরে রাশি-রাশি লোক নিজ-নিজ সুপরিচ্ছদে সজ্জিত ও দলবদ্ধ হইয়া প্রশস্ত আগ্রা নগর ও যমুনাতীর পরিপূর্ণ করিতেছে।

 পুরাতন রীত্যানুসারে আওরংজীব সুবর্ণের সহিত ওজন হইলেন, তাহার পর প্রধান প্রধান ওমরাহগণ ঐরূপে ওজন হইলেন। প্রত্যেক ওমরাহ রাজা ও মনসবদার সুবর্ণ, মুক্তা ও হীরক নজর দিয়া সম্রাটের মনস্তুষ্টি করিলেন।

 তাহার পর জগদ্বিমোহিনী কঞ্চনীগণ প্রৌঢ়-যৌবনমদে উন্মত্ত হইয়া অপূর্ব সঙ্গীত ও নৃত্য মায়া সভাসদগণের হৃদয় বিমোহিত করিল। কঞ্চনীগণ নর্তকী, বড় বড়

৭৮