পাতা:মাধবীকঙ্কণ - রমেশচন্দ্র দত্ত.pdf/৮০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

আরও সুশীতল করিতেছে, কল্লোলিনী যমুনা সুমধুর কল-কল শব্দে বহিয়া যাইতেছে। নরেন্দ্রনাথ অচিরাৎ নিদ্রায় অভিভূত হইলেন।

 তিনি কতক্ষণ নিদ্রিত রহিলেন তাহা স্থির করিতে পারিলেন না। নিদ্রায় একটি অপরূপ স্বপ্ন দেখিলেন। বোধ হইল, যেন অপূর্ব গোরস্থান হইতে মৃত মনুষ্য পুনর্জীবিত হইল, সে একটি মুসলমান স্ত্রীলোক। মৃত্যুর শ্বেতবর্ণ স্ত্রীলোকের মুখে এখন দেদীপ্যমান। স্ত্রীলোকের চক্ষু কোটরপ্রবিষ্ট, শরীর ক্ষীণ, সমস্ত অবয়ব দুঃখব্যঞ্জক। গোরস্থানে যে বায়েৎটি লেখা ছিল, শ্রীলোক যেন সেই বায়েৎটি গান করিল, সে দুঃখব্যঞ্জক গীতধবনিতে নরেন্দ্রের মুদ্রিত নেত্র হইতে একবিন্দু জল ভূতলে পতিত হইল। মুসলমানী যেন সহসা আর একটি গীত আরম্ভ করিল। নরেন্দ্রের বোধ হইল, যেন সে স্বর তাঁহার অপরিচিত নহে, বোধ হইল, যেন সে স্বর সেই অভাগিনী জেলেখার কণ্ঠনিঃসৃত। নরেন্দ্র, ভাল করিয়া দেখ, স্বয়ং জেলেখা গোরের উপর বসিয়া এই দুঃখগান গাইতেছে।

 নরেন্দ্রের স্বপ্নভঙ্গ হইল, চারিদিকে চাহিয়া দেখিলেন, কোথাও কেহ নাই। সূর্য অস্ত গিয়াছে, সন্ধ্যার ললাটে একটি উজ্জ্বল তারা বড় শোভা পাইতেছে, সন্ধ্যার বায়ু রহিয়া রহিয়া মৃদু গান করিতেছে, যমুনার জল অধিকতর নীলবর্ণ ধারণ করিয়া বহিয়া যাইতেছে।

 নরেন্দ্র বিস্মিত হইলেন। এই জেলেখার গান তিনি নিদ্রাযোগে ইতিপূর্বে তিন-চারবার শ্রবণ করিয়াছেন। জেলেখার প্রতি কি নরেন্দ্রের হৃদয় আকৃষ্ট হইয়াছে? নরেন্দ্র হৃদয় অনুসন্ধান করিয়া দেখিলেন, হৃদয় হেমলতাময়। জেলেখা কি মানবী নহে, জেলেখা কি পরী? তবে মানবের প্রেমাকাঙ্ক্ষিনী কেন? নরেন্দ্রনাথ ভাবিতে ভাবিতে সেই গোরস্থানের দিকে আসিলেন, সহসা গোরের পার্শ্ব হইতে স্বয়ং জেলেখা দণ্ডায়মান হইল। তাহার ক্ষীণ শরীর ও পাণ্ডুবর্ণ বদনমণ্ডল দেখিলে বোধ হয় যেন, যথার্থ কবর-গহ্ববরস্থ মৃতদেহ পুনর্জীবিত হইল। বদন পাণ্ডুবর্ণ বটে, কিন্তু নয়ন হইতে পূর্ববৎ তীব্র জ্যোতি বাহির হইতেছে। তীব্র জ্যোতির্ময়ী বামা সরোষে অধর দংশন করিয়া নরেন্দ্রের দিকে কটাক্ষপাত করিতেছে, বক্ষস্থলে একখানি তীক্ষ্ণ ছুরিকার অগ্রভাগ দেখা যাইতেছে। এই নারী কি দুঃখগান গাহিতেছিল? বোধ হয়, না।

 জেলেখা নরেন্দ্রকে আসিতে ইঙ্গিত করিয়া আপনি অগ্রে চলিল, অনেক দূর যাইয়া দুর্গের ভিতর প্রবেশ করিয়া রাজপ্রাসাদের একটি অন্ধকার গৃহে প্রবেশ করিল। নরেন্দ্র এতক্ষণ ইতিকর্তব্যবিমূঢ় হইয়া পশ্চাৎ পশ্চাৎ আসিতেছিলেন, এক্ষণে গৃহের ভিতর অন্ধকারে রমণীর সহিত যাইতে সঙ্কোচ করিয়া বলিলেন, “তুমি কে জানি না, আমি রাজপ্রাসাদে প্রবেশ করিবার অনুমতি পাই নাই।”

৮০