পাতা:মাধবীকঙ্কণ - রমেশচন্দ্র দত্ত.pdf/৮৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

অস্থিরা চঞ্চলচিত্তা, মানিনী। কত আব্দার করে, কত অভিমান করে, কত মিথ্যা ক্রোধ করে। কিন্তু যখন জীবনাকাশ ক্রমশঃ মেঘাচ্ছন্ন হইয়া আইসে, যখন পৃথিবীর সমস্ত সুখ নাট্যাভিনয়ের শেষে দীপশ্রেণীর ন্যায় একে একে নির্বাপিত হইতে থাকে, যখন আশা মরীচিকারূপে আমাদিগকে অনেক পথ লইয়া যাইয়া শেষে মরুভূমিতে রাখিয়া অদৃশ্য হয়, যখন বন্ধুগণ আমাদিগকে ত্যাগ করে ও লক্ষ্মী বিমুখ হয়, তখন কে অনন্যমনা ও অনন্যহৃদয়া হইয়া অভাগার শুশ্রূষা করে? মাতা ব্যতীত আর কে হতভাগার শয্যা রচনা করে? দুহিতা ব্যতীত আর কে রোগীর শুষ্ক ওষ্ঠে জলদান করে? ভার্যা ব্যতীত আর কে নিদ্রা বিস্মৃত হইয়া ক্লান্তি বিস্মৃত হইয়া দিবানিশি হতভাগার সেবায় রত থাকে? রমণীর প্রেম অগাধ, অপরিসীম। দারিদ্র্যে দুঃখে-কষ্টেও শৈব্যা হরিশ্চন্দ্রকে সেবা করিতে লাগিলেন। সে দুঃখের কথা শুনিয়া হেমলতার চক্ষুতে জল আসিল।

 তাহার পর আরও দুঃখ। রাজা শৈব্যাকে ও পুত্রটিকে বিক্রয় করিলেন, আপনাকে চণ্ডালের নিকট বিক্রয় করিলেন, অভাগিনী শৈব্যা স্বামীবিরহে কায়িক পরিশ্রমে আপনার ও পুত্রটির ভরণ-পোষণ করিতে লাগিলেন। আহা! সেই পুত্রটি অকালে কালপ্রাপ্ত হইল।—হেমমলতা আর থাকিতে পারিল না, ননদিনীর হৃদয়ে মস্তক স্থাপন করিয়া দরবিগলিত ধারায় রোদন করিতে লাগিল।

 গল্প সাঙ্গ হইল, রাজা রাজ্ঞীকে ফিরিয়া পাইলেন, পুত্রকে ফিরিয়া পাইলেন, রাজ্যসম্পদ সমস্তই ফিরিয়া পাইলেন। হেমলতার হৃদয় শান্ত হইল। অনেকক্ষণ প্রায় এক দণ্ডকাল উভয়েই নিস্তব্ধ হইয়া রহিল। অনেকক্ষণ পর হেমলতা ধীরে ধীরে উঠিয়া একটি বাতায়ন খুলিল। বাহিরে চন্দ্রকরে জগৎ উদ্দীপ্ত হইয়াছে, নৈশ বায়ুতে বৃক্ষসকল ধীরে ধীরে মস্তক নাড়িতেছে, দূর হইতে গঙ্গার জলের কুলকুল শব্দ শুনা যাইতেছে।

 শৈবলিনী ধীরে ধীরে হেমলতার নিকট আসিয়া ভগিনীর ন্যায় সস্নেহে তাহার হস্ত ধারণ করিল। হেম কি ভাবিতেছিল? ভাবিতেছিল ঐ বৃক্ষের পাতায় পাতায় কত জোনাকি পোকা দেখা যাইতেছে উহাদেরও জীবন আছে, সুখ দুঃখ বা ইচ্ছা আছে। যে ভগবান রাজা হরিশ্চন্দ্রকে বিপদ হইতে উদ্ধার করিলেন, তিনিই এই নিশায় অনিদ্র হইয়া ঐ পোকাগুলিকে খাদ্য যোগাইতেছন, উহাদিগের মনোবাঞ্ছা পুর্ণ করিতেছেন। এই বিপুল বিশ্বসংসারে সকল জীবজন্তুকে তিনিই রক্ষা করিতেছেন, তাঁহাকে নিবিষ্টমনে পূজা করি, আমাদিগকে তিনি রক্ষা করিবেন।

 হেমলতা বালিকাসুলভ সরলতার সহিত জিজ্ঞাসা করিল, “দিদি যিনি দয়ার সাগর, তিনি তোমাকে অল্পবয়সে বিধবা করিলেন কেন?”

৮৯