পাতা:মাধবীকঙ্কণ - রমেশচন্দ্র দত্ত.pdf/৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

বলিত নরেন্দ্রের বাপের জমিদারি, নবকুমারের জমিদারি' কেহ বলিত না। গ্রামের প্রজারাও নরেন্দ্রকে দেখিয়া জমিদারপুত্র বলিত। প্রকৃত জমিদার নবকুমার কি এ সমস্ত সহ্য করিতে পারেন? তিনি চিন্তা করিলেন, আমি কি অপবাদ বহন করিবার জন্যই এই জমিদার্নি করিলাম? পুনরায় নরেন্দ্রের সহিত হেমের বিবাহ হইলে কে না বলিবে, পিতার জমিদারি পুত্র পাইল, আমার নাম কোথায় থাকিবে? এতটা করিয়া কি পরিণামে এই ঘটিবে? আমি কি জমিদার হইয়াও বালকের দেওয়ান বলিয়া পরিগণিত হইব? কার্যেও কি তাহাই করিব, সযত্নে জমিদারি রক্ষা করিয়া পরে নরেন্দ্রকে ফিরাইয়া দিব? বিচক্ষণ প্রগাঢ়মতি নবকুমার এইরূপ চিন্তা করিয়া স্থির করিলেন যে, আপন নাম চিরস্মরণীয় করা আবশ্যক। তিনি পোষ্যপুত্র লইবেন অথবা কোন দরিদ্রের সহিত আপন কন্যা হেমলতার বিবাহ দিবেন।

 পণ্ডিতবর নবকুমার এইরূপ সুন্দর সিদ্ধান্ত করিয়া কার্যসাধনে যত্নবান হইলেন। নিকটস্থ একটি গ্রামে গোকুলচন্দ্র দাস নামক একজন ভদ্রলোক একটি পুত্র ও একটি বিধবা কন্যা ও অল্প সম্পত্তি বাখিয়া কাল গ্রাসে পতিত হন। পুত্রটির নাম শ্রীশচন্দ্র দাস, কন্যার নাম শৈবলিনী। নবকুমার শ্রীশচন্দ্রকে বীরনগরে আনাইয়া লালনপালন করিতে লাগিলেন। শৈবলিনী শশুরালয়ে থাকিত, কখন কখন ভ্রাতাকে দেখিবার জন্য বীরনগরে আসিয়া দুই-একদিন বাস করিত। ভ্রাতা ভিন্ন বিধবার আর কেহই এ জগতে ছিল না।

 বুদ্ধিমান নবকুমার দায়শূন্য ছিলেন না, বীরেন্দ্র জ্ঞাতি-কুটুম্বকে বাটী হইতে তাড়াইয়া দেন নাই; পরিচারিকারূপে তাঁহারা সকলেই আহারাদি কার্য করিত ও দিবানিশি প্রকাশ্যে নবকুমারের গৃহিণীর সাধুবাদ ও খোসামোদ করিত, গোপনে বিধাতাকে নিন্দা করিত। নবকুমার নরেন্দ্রকে এখনও লালনপালন করিলে, আপন অমাত্যবর্গের নিকট সর্বদাই ঈষৎ হাস্য করিয়া বলিতেন, “কি করি! বীরেন্দ্র জমিদারি বুঝিতেন না, সমস্ত বিষয়টি খোয়াইয়াছিলেন। পরের হাতে গেলে বীবেন্দ্রের পরিবার ও পুত্রের কষ্ট হয়, সেইজন্য আমিই ক্রয় করিলাম, নচেৎ জমিদারিতে বিশেষ লাভ নাই। এখন অনাথ নরেন্দ্রকে আমি লালনপালন করিতেছি। বীরেন্দ্রের অনেকগুলি পরিবার, আমি খাইতে পরিতে দিতেছি। কি করি, মানুষে কষ্ট পায়, এ তো আর চক্ষে দেখা যায় না! আর ভাবিয়া দেখ, ভগবান টাকা দিয়াছেন কি জন্য? পাঁচজনকে দিয়ে সুখ, রাখিতে সুখ না, পরকে দিব, তাহাতে যদি আমার কিছু না-ও থাকে সে-ও ভাল।”

 অমাত্যে বলিত, “অবশ্য, অবশ্য, আপনি মহাশয় শোক, আপনার দেয়ার শরীর, সেইজন্যই এমন আচরণ করিতেছেন, অন্যে কি এমন কয়ে? এই তো এত জমিদার আছে,