পাতা:মাধবীকঙ্কণ - রমেশচন্দ্র দত্ত.pdf/৯৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

হস্ত ধরিতে, আমি পাগলিনী, আমার সমস্ত শরীর কণ্টকিত হইত। পরে কেহ না থাকিলে আগ্রহের সহিত তোমাকে চুম্বন করিতাম। ক্ষমা কর, আমি পাগলিনী।

 ক্রমে বারাণসী হইতে নৌকাযোগে তুমি দিল্লীতে আনীত হইলে। আমি কোন ছলে তোমাকে রাজপ্রাসাদের ভিতরে আনিয়া আপন ঘরে রাখিলাম; কেবল তোমাকে চক্ষে দেখিবার জন্য আপন ঘরে রাখিলাম। তোমার মুখের দিকে চাহিয়া রজনী যাপন করিতাম; কখন কখন আত্মসংযম করিতে না পারিলে তোমার সংজ্ঞাশূন্য দেহ হৃদয়ে ধারণ করিতাম।

 দুষ্ট মসরুর তোমার কথা সাহেব-বেগমকে জানাইল। প্রাসাদের ভিতরে পুরুষ আনিয়াছি শুনিয়া তিনি আমার ও তোমার প্রাণ সংহারের আদেশ দিলেন। আবার মসরুর যাইয়া সাহেব-বেগমকে তোমার অপূর্ব বীরত্ব ও অপূর্ব সৌন্দর্যের কথা বলিল। বেগম পূর্বের আজ্ঞা রোধ করিলেন, আমাকে ঘরে বন্দী করিয়া রাখিলেন ও তোমার আরোগ্যের পর স্বয়ং আমাদের দোষের বিচার করিবেন এইরূপ আদেশ দিলেন।

 আমি বন্দী হইলাম, দিবারাত্রি ঘরে একাকিনী বসিয়া থাকিতাম; তোমাকে না দেখিয়া অসহ্য যাতনা হইত। অবশেষে তাহা সহ্য করিতে না পারিয়া দ্বাররক্ষক ও মসরুকে অনেক খোসামোদ করিয়া গোপনে তোমাকে দেখিতে যাইতাম। তখন তুমি আরোগ্যলাভ করিয়াছ, কখন কখন আমার দিকে চাহিয়া দেখিতে, তাহা কি স্মরণ হয়? আমি অধিকক্ষণ থাকিতে পারিতাম না, কথা কহিতে পারিতাম না। নিষ্ঠুর মসরুর আমাকে শীঘ্রই আপন ঘরে পাঠাইয়া দিত তথায় যাইয়া আমি আবার সেই দেবকান্তির চিন্তা করিতাম।

 ক্রমে বিচারের দিন সমাগত হইল; সেদিন তোমার স্মরণ আছে? সিংহাসনোপবিষ্ট জেহান-আরার চারিদিকে সহচরীগণ দাঁড়াইয়া ছিল, তাহা তোমার স্মরণ আছে? সাহেব-বেগম সেইদিন প্রথমে তোমাকে দেখিলেন; যে কঠোর আজ্ঞা দিলেন, তোমার স্মরণ আছে? শাহাজাদি। আমার পাপের কি এই উচিত দণ্ড? তুমিও স্ত্রীলোক, তোমার হৃদয় কি পাষাণ, কখনও বিচলিত হয় নাই। তবে আমি বাঁদী, আমার স্বাধীনতা নাই, সেইজন্য আমার পাপের দণ্ড দিলে! কিন্তু তুমি সিংহাসনোপবিষ্টা রাজ-দুহিতা, আমা অপেক্ষাও যে ঘোর পাপীয়সী, তাহার কি দণ্ড নাই?

 কি কৌশলে সেই রাত্রে আমি দুর্গ হইতে তোমাকে লইয়া পলায়ন করিলাম তাহা বলিবার আবশ্যক নাই। তাহার পরই সৈনিকবেশে তুমি দিল্লী ত্যাগ করিলে, এই অভাগিনীও দেওয়ানা নাম ধারণ করিয়া পুরুষবেশে তোমার সঙ্গে সঙ্গে যাইল। নরেন্দ্র! তোমার প্রণয়ভাজন হইব, এরূপ আশা হৃদয়ে ধারণ করি নাই, দিবারাত্রি তোমার নিকটে

৯৩