পাতা:মাধবীকঙ্কণ - রমেশচন্দ্র দত্ত.pdf/৯৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 ক্রমে রজনী অধিক হইল, হেমন্তকালের চন্দ্রালোকে নদী, গ্রাম, বৃক্ষ ও মন্দির অতি সুন্দরকান্তি ধারণ করিল। নীল গগনে সুধাংশু যেন ধীরে ধীরে আসিতেছে। নদীবক্ষে এই একখানি ক্ষুদ্র তরী ভাসমান রহিয়াছে। নদীর দুই পাশে নিবিড়কৃষ্ণ বৃক্ষশ্রেণী নিঃশব্দে দণ্ডায়মান রহিয়াছে; বোধ হইতেছে যেন চন্দ্রের সুধাবর্ষণে সমগ্র জগৎ তৃপ্ত হইয়া সুখে নিদ্রিত রহিয়াছে।

 সহসা নগরের মধ্যে সায়ংকালীন পূজা আরম্ভ হইল, শত শত দেবালয় হইতে শঙ্খ-ঘণ্টা নিনাদ শ্রুত হইতে লাগিল। সায়ংকালীন বায়ুহিল্লোলে সুদুরশ্রুত সে নিনাদ কী সুমধুর, কী মিষ্টি। সেই ঘণ্টারব ধীরে ধীরে নদীর বক্ষে ও নগরের চতুর্দিকে বিস্তৃত হইতে লাগিল, ধীরে ধীরে সেই নীল অনন্ত নৈশ গগনে উত্থিত হইতে লাগিল, উপাসকাদগের মন যেন মুহূর্তের জন্য ও পৃথিবীর চিন্তা বিস্মৃত হইয়া সেই পবিত্র ঘণ্টা রবের সহিত গগনের দিকে প্রবাহিত হইতে লাগিল।

 নদীকূলে একটি প্রস্তর-বিনির্মিত সোপানশ্রেণীর উপরেই গোলোকনাথের মন্দির; সেই দেবমন্দিরে আরতি হইতেছিল। বহুসংখ্যক ব্রাহ্মণ ও পূজক উচ্চৈঃস্বরে সায়ংকালীন গীত গাহিতেছিল, অনেক যাত্রী সে পূজায় উপস্থিত যাত্রীদিগের মধ্যে স্ত্রীলোকই অধিক, বহু দূর হইতে, বহুদেশ হইতে এই পুণ্যস্থানে সমবেত হইয়া অদ্য মন্দির দর্শন করিয়া যেন জীবন চরিতার্থ করিল।

 আরতি শেষ হইল যাত্রিগণ নিজ নিজ গৃহে চলিয়া গেল, কেবল দুইজন স্ত্রীলোক সেই মন্দিরপার্শ্বে একটি বৃক্ষতলে দণ্ডায়মান হইয়া কথোপকথন করিতেছিল।

 হেমলতা ঈষৎ হাসিয়া বলিল, “দিদি মুসলমানী বলিয়াছিল, আজ এই মন্দিরে এক প্রহর রাত্রির সময় নরেন্দ্রের সঙ্গে দেখা হইবে, কৈ, তাহা হইল না।”

 শৈবলিনী অতিশয় বুদ্ধিমতী, হেমের কথা শুনিয়া বুঝিতে পারিল যে, যদিও হেম হাসিতে হাসিতে ঐ কথা জিজ্ঞাসা করিল, তথাপি হেমের হৃদয় যথার্থই উদ্বেগে পরিপূর্ণ। সেই আশায় হেমের হৃদয় আজি সজোরে আঘাত করিতেছে, হেমের শরীর এক-একবার অল্প অল্প কম্পিত হইতেছে।

 শৈবলিনী মনে মনে ভাবিল আজ না জানি কি কপালে আছে; হেম বালিকা মাত্র, নরেন্দ্রকে দেখিলে আবার পূর্বকথা মনে করিবে সে অসহ্য যাতনা বালিকা কি সহ্য করিতে পারিবে? প্রকাশ্যে বলিল, “সে পাগলিনীর কথায় কি বিশ্বাস করে? নরেন্দ্র কোথায় কোন্ দেশে আছে, তাহার সহিত মথুরায় দেখা হইবার আশা করিতেছ?”

 হেমলতা। কিন্তু দিদি জেলেখার জন্য কথাগুলি তো ঠিক হইয়াছিল।

 শৈবলিনী। ঐ প্রকারে উহারা মিথ্যা আশা জন্মায়, দু'টা সত্য কথা বলে, একটা

৯৭

মাধবীকঙ্কণ—৭