পাতা:মাধবীকঙ্কণ - রমেশচন্দ্র দত্ত.pdf/৯৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

মিথ্যা কথা বলে। কৈ, আমাদের দাসী আসিল না? আমি যে পথ ঠিক চিনি না, না হইলে আমরা দুইজনেই বাড়ি যাইতাম।

 হেম। দেখ দিদি, আমার বোধ হইতেছে, যেন এই আমাদের বীরনগর যেন এই গঙ্গা। আর বাল্যকালে চন্দ্রালোকে গঙ্গাতীরে খেলা করিতাম। তোমার সহিত খেলা করিতাম, অরি—আর —আর, সকলের সহিত খেলা কবিতাম, সেই কথা মনে পড়িতেছে।

 শৈবলিনীর মুখ আবার গম্ভীর হইল, দাসীর আসিতে বিলম্ব হইতেছে বলিয়া শৈবলিনী যৎপরোনাস্তি উৎসুক হইল। হেম তাহা লক্ষ্য না করিয়া আবার বলিতে লাগিল, “দেখ দিদি ঐ নৌকাখানি কেমন তীরের মত আসিতেছে। উঃ! মাঝিরা কী জোরে দাঁড় বহিতেছে! উঃ! যেন উডিয়া আসিতেছে।”

 শৈবলিনী সেইদিকে দেখিল; তাহার ভয় দ্বিগুণ হইল। শৈবলিনী যাহা ভয় করিতেছিল, তাহাই হইল,—নৌকা ঘাট হইতে চারি হস্ত দূরে থাকিতে একজন সৈনিক লম্ফ দিয়া ঘাটে পড়িল, সৈনিক নরেন্দ্রনাথ!

 হেম বৃক্ষের ছায়ায় ছিল, নরেন্দ্র তাহাকে না দেখিতে পাইয়া মন্দিরের ভিতর যাইলেন। কিন্তু হেম নরেন্দ্রকে দেখিয়াছিল, সেই মুহূর্তে যেন শরীরের সমস্ত রক্ত হেমের মুখমণ্ডলে দৃষ্ট হইল, চক্ষু কর্ণ, ললাট, স্কন্ধ একেবারে বক্তবর্ণ হইয়া গেল। পর-মুহূর্তে সমস্ত মুখমণ্ডল পাণ্ডুবর্ণ হইল, শরীর কাঁপিতে লাগিল, ললাট হইতে স্বেদবিন্দু বহির্গত হইতে লাগিল।

 শৈবলিনী সভয়ে হেমকে ধরিল। হেম কিঞ্চিৎ আরোগ্যলাভ করিলে শৈবলিনী গম্ভীরস্বরে বলিল,—“হেম, আমি তোমাকে ভগিনী অপেক্ষা ভালবাসি। আমি বলিতেছি, আজ নরেন্দ্রের সহিত দেখা করিও না, বাড়ি চল। তুমি আমাকে ভগিনী অপেক্ষা ভালবাস, আমার এই কথাটি শুন, বাড়ি চল। তুমি বালিকা, আপনার মন জান না, নরেন্দ্রের সহিত অদ্য তোমার কথোপকথন হইলে কি বিপদ ঘটিবে, ভগবান জানেন।”

 হেমলতা মুখ নত করিয়া এই কথা শুনিল, অনেকক্ষণ ভূমির দিকে দৃষ্টি করিতে লাগিল, নয়ন হইতে দুই এক বিন্দু স্বচ্ছ অশ্রু স্বচ্ছ বালুকায় পড়িয়া অদৃশ্য হইল। আবার ধীরে ধীরে মুখখানি তুলিল। তখন উদ্বেগের লেশমাত্র চিহ্ন নাই; হেমের মুখখানি শান্ত, নির্মল, স্থির। নয়নে কেবল একবিন্দু অশ্রুজল।

 হেম শৈবলিনীর দিকে চাহিয়া বলিল, “দিদি, তুমি আমার প্রাণের অপেক্ষা প্রিয়, তুমি আমাকে অবিশ্বাস করিও না। দিনে দিনে, মাসে মাসে, তুমি আমাকে কত ধর্ম উপদেশ দিয়াছ, আমি তাহা ভুলি নাই। দিদি, আমি অবিশ্বাসিনী নহি। আজি এইমাত্র

৯৮