পাতা:মানিক গ্রন্থাবলী.pdf/৩১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
জননী

লাগে না, সর্বদা খুঁতখুঁত করে। কারণে-আকারণে রাগিয়া কাঁদিয়া সকলকে মারিয়া অনর্থ বাধাইয়া দেয়। মন্দা প্রাণপণে তাহাদের তোয়াজ করিয়া চলে। সে যেন দাসী, রাজার ছেলে দুইটি দুইদিনের জন্য তাহার অতিথি হইয়া সৌভাগ্য ও সম্মানে তাহাকে পাগল করিয়া দিয়াছে, ওদের তুষ্টির জন্য প্রাণ না দিয়া সে ক্ষান্ত হইবে না। শ্যামা প্রথমে বুঝিতে পারে নাই, পরে টের পাইয়াছে, এমনিভাবে মাতিয়া থাকিবার জন্যই মন্দা এবার ছেলে দুইটিকে সঙ্গে আনিষাছে। সেখানে শাশুড়িকে অতিক্রম করিয়া ওদের সে নাগাল পায় না। স্বাদ মিটাইয়া ওদের ভালবাসিবার জন্য, আদর যত্ন করিবার জন্য, সেই যে ওদের আসল মা, এটুকু ওদের বুঝাইয়া দিবার জন্য মন্দা এবার ওদের সঙ্গে অনিয়াছে।

 আনিয়াছে চুরি করিয়া।

 মন্দাই সবিস্তারে শ্যামাকে ব্যাপারটা বলিয়াছে। কথা ছিল, শুধু কোলের ছেলেটিকে সঙ্গে লইয়া মন্দা আসিবে, শাশুড়ীর দুই চোখের দুইটি মণি যমজ ছেলে দুইটি, কানু আর কালু, শাশুড়ীর কাছেই থাকিবে। কিন্তু এদিকে কাঁদাকাটা করিয়া স্বামীর সঙ্গে যে গভীর ও গোপন পরামর্শ মন্দা করিয়া রাখিয়াছে, শাশুড়ী তার কি জানেন? মন্দাকে আনিতে গিয়াছিল শীতল, কানু ও কালু স্টেশনে আসিয়াছিল বেড়াইতে, রাখাল সঙ্গে আসিয়াছিল তাহদের ফিরাইয়া লইয়া যাইবার জন্য। গাড়ি ছাড়িবার সময় রাখাল একাই নামিয়া গিয়াছিল। কানু ও কালু তখন নিশ্চিন্ত মনে রসগোল্লা খাইতেছে।

 শীতল বলিয়াছিল, গাড়ি ছাড়ার সময় হল, ওদের নামিয়ে নাও হে রাখাল। রাখাল বলিয়াছিল — যাক না যাক; মামাবাড়ি থেকে কদিন বেড়িয়ে আসুক।

 মন্দা বলিয়াছিল, ওরাও যাবে দাদা। উনি টিকিট কেটেছেন, এই নাও।

 শ্যামাকে ব্যাপারটা বলিবার সময় মন্দা এই সংক্ষিপ্ত কথোপকথনটুকু উদ্ধৃত করিতেও ছাড়ে নাই, বলিয়াছে — দাদা কিছু টের পায় নি বৌ, ভেবেছিল শাশুড়ী বুঝি সত্যি সত্যি শেষে মত দিয়েছে। ফিরে গেলে যা কাণ্ডটা হবে! পেটের ছেলে চুরি করার জন্য আমায় না শেষে জেলে দেয়।

 এদিক দিয়া শ্যামার বরাবর সুবিধা ছিল, স্বামীর জননীর খেয়াল মত কখনো তাহাকে পুতুল নাচ নাচিতে হয় নাই। তবু, মাঝে মাঝে শাশুড়ীর অভাবে তাহার কি কম ক্ষোভ হইয়াছে। আর কিছু না হোক, বিপদে আপদে মুখ চাহিয়া ভরসা

৩৭