পাতা:মানিক গ্রন্থাবলী - মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/৪৪০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

মানিক গ্ৰন্থাবলী হয়েছে। আর অনুরূপ প্ৰায় নিজের অজ্ঞাতসারেই একটু একটু করে বাপের সেবার ভার তাকে ছেড়ে দিয়ে এসেছে। মনের আড়ালে যে বিরোধ ও বিতৃষ্ণ জমেছে অনুরূপার সেটা একদিনের সঞ্চয় নয়, নিজে সে ভালো করে জানেও না যে প্ৰয়োজন ও অভ্যাস ছাড়া স্বামীর কাছে যাবার তাগিদ সে কখনো অনুভব করে না ! মেয়েকে বাপের সেবা শেখান যে তারই বিদ্রোহের প্রকাশ, এটা কল্পনা করার ক্ষমতাও অনুরূপার নেই। দুরে যাবার, তফাতে থাকার—তাগিদ যে অহরহ তার মধ্যে জেগে আছে, অনুরূপ তা জানে না, জানলেও বিশ্বাস করবে না । বাবার জন্য ছোট বড় কাজগুলি করে যাওয়া চারুর জীবনযাত্রার সঙ্গে খাপ খেয়ে জড়িয়ে গেছে। বড় হওয়ার সঙ্গে যা কিছু বেড়েছে চারুর জীবনে বা নতুন এসেছে, সব মানিয়ে নেওয়া হয়েছে এই কর্তব্যের সঙ্গে । চারু ভাবে না যে বাবার জন্য দশবার উঠে আসতে হওয়ায় পড়ায় তার ছেদ পড়ল। দশবার উঠে আসার ফ্যাকগুলিই তার পড়ার জন্য। সংসারের কাজে মা তাকে প্ৰায় ডাকেই না, সেটা অবশ্য তাকে পড়া করা আর গান শেখার সুযোগ দিতে । কিন্তু বাবার কাজ আলাদা, সংসারের কাজের সঙ্গে তার সম্পর্ক নেই । চা করা, খাবার করা, ভাত রাধা, সংসারের কাজ, ওসব মা করে । চায়ের কাপ, খাবারের রেকবি, ভাতের থালা বাবার সামনে পৌছে দেওয়া তার কাজ। বাবা জল চাইলে মা কলসী থেকে গেলাসে জল গড়িয়ে দেওয়া পৰ্যন্ত করতে পারে, বাবাকে গেলাসটা কিন্তু দিতে হবে তাকেই । বাবার জাম-কাপড়, পোশাক-পরিচ্ছদের হিসাব রাখা, বইখাতা-কাগজ-পত্ৰ গুছিয়ে রাখা, বিছানা পাতা, চটি এগিয়ে দেওয়া, বাতাস করা, ঘামাচি মারা ইত্যাদি যত কিছু করা দরকার সেগুলি করার জন্য চারু জন্মেছিল পৃথিবীতে। নীরদকে যেমন ভয় করে, তেমনি ভক্তি করে চারু। প্ৰতিদিনের চলতি সেবার অতিরিক্ত কোনো সেবা করার সুযোগ পেলে সে যেন কৃতাৰ্থ হয়ে যায়। নীরদের ছোট-খাট অসুখ হলে সে উদগ্রীব, উৎসুক হয়ে থাকে—যা কিছু করার আছে তারও বেশি কিছু করার সাধ চাপা উচ্ছাসের মতো তার ছোট বুকটিতে ঠেলে উঠতে চায়। নীরদ চোখ বুজে পড়ে থাকে সামান্য অসুখের ধাক্কায়, চারু তার ভারিকি প্রৌঢ় মুখে ক্ষমতা, শাসন ও মমতায় গড়া মৃদু ভয়ংকর রহস্য দেখে দেখে মনের মধ্যে বিহ্বল হয়ে যায়। 8 8 R