পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র প্রথম খণ্ড.djvu/২০৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

bang labOOKS. in আগন্তক স্টেশনে নামিয়া মুকুল চারিদিকে চাহিয়া দেখিতে লাগিল। সে বড়ো বিস্মিত হইয়াছে। পাঁচ বছরে স্টেশনটির কোনো পরিবর্তন হয় নাই, এমনকী, পার্সেল আপিসের দেয়ালে যেখানে যে অবস্থায় বুলিতেছে, কিন্তু তবু চারিদিকে কেমন যেন অপরিচয্যের ছাপ। কিছুই সে ভোলে নাই, কঁাকর-বিছানো প্ল্যাটফর্ম, কালো আর সাদা রঙের পাঁচটা সিগন্যাল লিভার, ইটের উপর লাল রং-করা রেলের আপিস, ওয়েটিং রুমের ধুলামাখা খড়খড়ি, টিকিট-ঘরের ঘুলঘুলিতে মরিচা-ধরা লোহার শিক আব্ব বাহিবে যাওয়ার পথে বাঁকানো লোহার পাতের নিক্ষমা গেট, সবই সে বেশ চিনিতে পারিতেছে, কিন্তু আজিকাব চেনা কেমন যেন অভিনব। এই জড় পদার্থগুলোর সঙ্গে তার পরিচয়ের যোগসূত্রটি যেন ছিড়িষ্যা গিয়াছিল ; স্টেশনে নামিয়া দাঁড়ানো মাত্র গিট পড়িয়া তার দুটি ছিন্নপ্রান্ত জুড়িয়া গেল, কিন্তু গিাঁটের অস্তিত্বটাই হইয়া রহিল স্বপ্রধান। স্বাভাবিক মোলায়েম যোগ যেন নাই, গিটের মধ্যে যে কৌশল ও শক্তিটুকু সংহত হইযা আছে তারই কল্যাণে পরিচয় বজায় আছে। মুকুলের যেন সব ভুলিয়া যাওয়া উচিত ছিল ; স্টেশনেৰ যেন এমনভাবে বদলাইয়া যাওয়া উচিত ছিল যে দেখিলে সে না চিনিতে পারে,-মুকুল যে মনে রাখিযাছে, স্টেশনটি যে বদলায় নাই, দুপক্ষেরই সে বিশেষ অনুগ্রহ। পাঁচ বছর পরে বাড়ি আসার আনন্দ ও উৎসাহ মুকুলের ঝিমাইয়া পডিল। জড়-জগতের এ কী বিবৃপ অভ্যর্থনা । ছোটাে ভাই অতুল দাদাকে লাইতে আসিয়াছিল। বিচলিত বিব্রত ও সলজভাবে সে মুকুলকে অভ্যর্থনা কবিল, গাড়িটা আধঘণ্টা লেট করিয়াছে। অতুল বড়ো হইযাছে। গোপের কালো রেখায় তার মুখখানা দেখিতে হইয়াছে বিশ্ৰী। এখন আর তার পিঠ চাপড়ানো যায় না, তাকে একজন আস্ত পুরা মানুষ বলিয়াও স্বীকার করা চলে না। কতখানি স্নেহ আব্ব কতখানি সম্মান তার প্রাপ্য স্থির করা আজ সমস্যার ব্যাপার। দাঁড়ান, একটা গাডি ঠিক করে ফেলি। কিছুক্ষণের জন্য সম্মুখ হইতে সে পালাইতে চায়। দাদা আসিবে বলিয়া তাহার আনন্দ কম হয় নাই, কিন্তু সে আনন্দ প্ৰকাশ করিতে তাহার লজ্জা করে। অথচ প্রকাশ না করাটাও কেমন যেন খারাপ দেখায়। অতুল নিজে মনে মনে অনেকদিন বিদেশে কাটাইয়া বাড়ি আসিবার কল্পনা করিয়া দেখিয়াছে, সকলে আনন্দে উচ্ছসিত হইয়া উঠিবে, চারিদিকে হইহাই সমারোহত লাগিয়া যাইবে, এমনি একটা অভ্যর্থনার আশাই মনে সব চেয়ে প্রবল। মুকুলও নিশ্চয় ও রকম কিছু আশা করিতেছিল, আশা পূৰ্ণ না হইলে ওর মনে ব্যথা লাগিব।াল সম্ভাবনা। অথচ একটু সংক্ষিপ্ত সলজ হাসি ছাড়া দাদাকে সে কিছুই দিতে পাবিল না। দাদা নিশ্চয় এই ভাবিয়া মনে মনে দুঃখ করিতেছে, এমন পর হইয়া গেছে তার ছোটাে ভাই, যে তাকে দেখিয়া ওর এতটুকু আহ্বাদও হয় নাই। মুকুল বলিল, চল, আমিও যাচ্ছি। অতুল মুখের দিকে তাকায় না, ডান পাশে একটু আগে আগে চলিতে থাকে। মুকুল জিজ্ঞাসা করিল, বাড়িতে কে কে আছে রে অতুল ?