পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র প্রথম খণ্ড.djvu/৩০২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

bang labOOKS. in WS0o S মানিক রচনাসমগ্ৰ আত্মোপলব্ধির বুপান্তর দিতে পারে না, হেরম্ব তা জানে। সে স্বীকার করে বলল, তা যায় না। আনন্দ, কিন্তু সে জন্য তুমি বিচলিত হচ্ছে কেন ? বেশি দিন নাইবা বাঁচল, যতদিন বঁাচবে তাতেই আমাদের ভালোবাসা। ধন্য হয়ে যাবে। ভালোবাসা মরে গেলে আমাদের যে অবস্থা হবে এখন তুমি তা যত ভয়ানক মনে করছ, তখন সে রকম মনে হবে না। ভালোবাসা মরে কখন ? যখন ভালোবাসার শক্তি থাকে না। যে ভালোবাসতে পারে না, প্ৰেম না থাকলে তার কী এসে যায় ? আনন্দ বিস্মিত হয়ে বললে, একী বলছি? যা নেই তার অভাব-বোধ থাকবে না ? থাকবে, কিন্তু সেটা খুব কষ্টকর হবে না। আমাদের মন তখন বদলে যাবে। যাবেই ? কিছুতেই ঠেকানো যাবে না ? সোজাসুজি জবাব হেরম্ব দিল না। হঠাৎ উপদেষ্টার আসন নিযে বলল, এ সব কথা নিয়ে মন খারাপ কোরো না, আনন্দ । বেশিদিন বাঁচলে কি প্রেমের দাম থাকত ? তোমার ফুলগাছের ফুল ফুটে ঝরে যায়, তুমি সে জন্য শোক করা নাকি ? ফুল যে রোজ ফোটে। কিছুক্ষণেব জন্য হেরম্ব বিপন্ন হয়ে রইল। তার মনে হল, আনন্দেব কথায একেবাবে চরম সত্যটি বুপ নিয়েছে, এখন সে যাই বলুক সে শুধু তর্কেব খাতিবে বলা হবে, তার কোনো মানে থাকবে না। কদিন থেকে প্রযোজনীয় নিদ্রার অভাবে হেরম্বর মস্তিষ্ক অবসন্ন হয়ে পড়েছিল, জেনাব কবে ভাবতে গিয়ে তার চিন্তাগুলি যেন জড়িয়ে যেতে লাগল। অথচ সত্যকে চিবদিন বিনা প্রতিবাদে গ্ৰহণ কবে এসে আনন্দেব উপমা-নিহিত অন্তিম সত্যকে কোনোরকমে মানতে পাবছে না দেখে তৰিব আশা হল, বংশাহীন ফুলের মতো একবার মাত্র বিকাশ লাভ কবে ঝরে যাওয়াব ব্যর্থতাই মানব-হ্রদ যোেব। চরম পরিচয় নয়, বিকাশের পুনরাবৃত্তি হয়তো আছে, হ্রদায়ের পুনর্জন্ম হয়তো অবিবাম ঘটে চলেছে। মানুষের মৃত্যু-কবলিত জীবন যেমন সার্থক, তেমনি সার্থকতা ক্ষণজীবী তৃদযেবও হয়তো আছে। হেরম্ব যতক্ষণ ব্যাকুল হয়ে চারিদিকে অন্ধের মতো হাতড়ে খুজে বেড়াতে লাগল। এই সার্থকতাব স্বরুপ তার কাছে ধরা পডল না। হেরম্বের নিদ্রাতুর মনও বেশিক্ষণ খেইহারা চিন্তার অর্থহীন বিড়ম্বনা ভোগ করবার মতো নয়। ক্ৰমে ক্ৰমে সে শান্ত হয়ে এলে এত সহজে হৃদয়েব মৃত্যু-বহস্য তাব কাছে স্বচ্ছ হয়ে গেল যে, এই সুলভ জ্ঞানের জন্য ছেলেমানুষের মতো উত্তেজিত হয়ে উঠেছিল বলে নিজের কাছেই সে লিজা পেল। সে প্রীতিকবি প্রসন্ন হাসি হেসে বলল, মানুষও রোজ ভালোবাসে, আনন্দ। প্রত্যেকটি ঝরে—যাওয়া ভালোবাসার জায়গায় আবার তেমনি একটি করে ভালোবাসা জন্মায়। আমরা মানুষ, গাছ-পাথরের মতো সীমাবদ্ধ নই। আমাদের চেতনা সমস্ত বিশ্বে ছড়িয়ে আছে, পৃথিবীর সমস্ত মানুষের সঙ্গে এক হয়ে আমরা বেঁচে আছি। আমি যেমন সমস্ত মানুষের প্রতিনিধি, সমস্ত মানুষ তেমনি আমার প্রতিনিধি। একটা প্রকাণ্ড হৃদয় থেকে একটুকরো ভাগ করে নিয়ে আমার স্বতন্ত্র হৃদয় হয়েছে, কিন্তু নাড়ি কাটার পরেও মা আর ছেলের যেমন নাড়ির যোগ থাকে, সমস্ত মানুষের সমবেত অখণ্ড হৃদয়ের সঙ্গে আমারও তেমনি আত্মীয়তা আছে। তুমি ভাবিছ এ শুধু কল্পনার বাহার। তা নয়, আনন্দ। আকাশ আর বাতাস থেকে আমার মন, আমার তুদয় নিজেকে সংগ্রহ ও সঞ্চয় করেনি, তাদের প্রত্যেকটি কণা এসেছে মানুষের ভান্ডার থেকে। আমরা জন্মাই একটা বিপুল শূন্য নিয়ে, আজীবন মানুষের সাধারণ হৃদয়-মনের সম্পত্তি থেকে তিলতিল করে ঐশ্বর্য নিয়ে সেই শূন্য পুরণ করি। আমরা তাই পরস্পর আত্মীয়, আমরা তাই প্রত্যেকে সমস্ত মানুষের মধ্যে নিজেদের অনুভব করতে পারি। তাই আমাদের ভালোবাসা যখন মরে যাবে, অন্য মানুষ তখন ভালোবাসবে। আমাদের প্রেম ব্যর্থ হবে না।