পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র প্রথম খণ্ড.djvu/৩৪৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

bang labOOKS. in V98Ե" মানিক রচনাসমগ্ৰ ভূতের অবস্থা দেখিয়া শশীর মুখ স্নান হইয়া গেল। ছেলেটা বঁচিবে না। এ সন্দেহ তাহার ছিল ; তবু দুপুরবেলা ওকে দেখিয়া গিয়া একটু আশা তাহার হইয়াছিল। বইকী। এক বেলায় অবস্থাটা মো এ রকম দাঁড়াইবে সে তাহা ভাবিতেও পারে নাই। ছেলেটার সর্বাঙ্গে সে জডাইয়া জড়াইয়া ব্যান্ডেজ বঁধিয়াছিল। নড়িবার উপায় তাহার নাই, এখন থাকিয়া থাকিয়া মুখটা শুধু বিকৃত করিতেছে। শশীর গলা এমনই মৃদু, এখন আরও মৃদু শোনাইল-একটু আগুন চাই সেঁক দেবার-- গরম কাপড় যদি এক টুকরো থাকে ? বিধবা বউটি মালসায় আগুন আনিল। একটা আলোয়ান ভাঁজ করিয়া শশীর নির্দেশ মতো ভুতোর বুকে সেঁক দিতে লাগিল। শশী তাহাকে একটা ইনজেকশন দিয়া একটু অপেক্ষা করিল। বারবার চোখের ভিতরটা লক্ষ করিয়া দেখিল, নাড়ি টিপিল, তার পর নীরবে উঠিয়া আসিল। সকলে এতক্ষণ শ্বাসবোধ করিয়া ছিল, শশীব উঠিয়া আসার ইঙ্গিতে ঘরে তাহদের সমবেত কান্না একেবারে ভাঙিয়া ळ्नि । বিধবা বউটি পাগলের মতো ছুটিয়া আসিয়া শশীর পথ রোধ করিয়া বলিল, না, তুমি যেতে পাবে না। শশী, আমার ভূতোকে বাঁচিয়ে যাও! যাও আমার ভূতোকে বঁচিয়ে। ও যে আমাব জন্যে জাম আনতে গাছে উঠেছিল শশী! শশী কী বলিবে? সে গভীর হইয়া থাকে। তারপর পথ পাইলে বাহির হইয়া যায। জুতা হাতে করিয়া সে নামিয়া যায় পথে। পায়ে-চলা পথটির শেষেও সে কান্নার শব্দ শুনিতে পায়। শ্ৰীনাথ দাসের মুদি দোকানের সামনে বাঁশের বাতার তৈরি বেঞ্চিতে বসিয়া কয়েকজন জটলা করিতেছিল। বোধ হয়। গল্পে মশগুল থাকায় বাসুদেবের সঙ্গে যাওয়ার সময় শশীকে তাহারা দেখিতে পায় নাই। এবাব শ্ৰীনাথ দেখিতে পাইয়া ডাকিয়া বলিল, একটু বসে যান ছোটোবাবু,--টুলটা ছাড় দেখি নিয়োগীমশায়, ছোটােবাবুকে বসতে দাও। ` V পঞ্চানন চক্রবর্তী জিজ্ঞাসা করিল, কোথা গিয়েছিলে শশী ? শশী বলিল, বাসুদেব বঁড়িয্যের বাড়ি, ভুতো এইমাত্র মাবা গেল। বটো? বাঁচল না বুঝি ছেলেটা ? তবে তোমাকে বলি শোন শশী, ভুতো যেদিন পডল আছাড খেয়ে, দিনটা ছিল বিযু্যদবার। খবর পেয়ে মনে কেমন খটকা বাধল। বাড়ি গিয়ে দেখলাম পাঁজি,- যা ভেবেছিলাম। ছেলেটাও পড়েছে-বারবেলাও হয়েছে খতম! লোকে বলে বারবেলা, বারবেলা কি সবটাই সর্বনেশে বাপু ? বিপদ যত ওই খতম হবার বেলা। বারবেলা যখন ছাড়ছে, পায়ে কাটাটি ফুটলে দুনিয়ে উঠে আক্কা পাইয়ে দেবে।-নবীন জেলের বড়ো ছেলেটাকে সেবার কুমিরে নিলে, সেদিনও বিষু্যদবার, সেবারও ছেলেটা খালে নামল বারবেলাও অমনি ছেড়ে গেলা-গাওদিয়ার খালে। নইলে কুমির আসে? খালের কুমির শুধু নয়, ভূতের কথায় ভূতের কথাও আসিয়া পড়িল। তারপর বাজারের সন্ন্যাসী, বাজার দর, একাল সেকালের পার্থক্য, নারী হরণ, পূর্ণ তালুকদারের মেয়ের কলঙ্ক, বিদেশবাসী গায়ের বড়ো চাকুরে সুজন দাস, এই সব আলোচনা। শশী কি এত উচুতে উঠিয়া গিযাছে যে এই সব গ্ৰাম্য প্রসঙ্গে তাহাব মন বসিল না, শান্ত অবহেলার সঙ্গে নীরবে শুনিযা গেল? তা তো নয়। শুধু আধখানা মন দিয়া সে ভাবিতেছিল, এতগুলি মানুষের মনে মনে কী আশ্চর্য মিল। কারও স্বাতন্ত্র্য নাই, মৌলিকতা নাই, মনের তারগুলি এক সুরে বাঁধা। সুখদুঃখ এক, রসানুভূতি এক, ভয় ও কুসংস্কার এক, হীনতা ও উদারতার হিসাবে কেউ কারও চেয়ে এতটুকু ছোটাে অথবা বড়ো নয। পঞ্চানন জমিদার সরকারের মুহুরি, কীর্তি নিয়োগী পেনশনপ্রাপ্ত হেড পিওন, শিবনারায়ণ গায়ের বাংলা স্কুলের মাস্টার, গুরুগতির চাষ আবাদ-ব্যাবসা ইহাদের পৃথক,-মনগুলি এক ধাঁচে গড়িয়া