পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র প্রথম খণ্ড.djvu/৪২৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

bang labOOKS. in 8 SV মানিক রচনাসমগ্ৰ হাসি হাসিয়াছিলেন, পাগলদিদি তখন চোখ বুজিয়াছেন। যাদবের মুখ ঢাকিয়া গিয়াছিল চটচটে ঘামে আর কালিমায়, চোখের তারা দুটি সংকুচিত হইয়া আসিয়াছিল। তিন-চার হাজার ব্যগ্ৰ উত্তেজিত লোকের মধ্যে ডাক্তার শুধু শশী একা, সে শিহরিয়া উঠিয়াছিল। তবু পলক সে ফেলিতে পারে নাই। যাদব ও পাগলদিদির দেহে পরিচিত মৃত্যুর পরিচিত লক্ষণগুলির আবির্ভাব একে একে চাহিয়া দেখিয়াছিল। সকলে যখন টের পাইল যাদবের সঙ্গে পাগলদিদিও পরলোকে চলিয়াছেন, যাদবের আগেই হয়তো তাহাব শেষ নিশ্বাস পড়িবে, চারিদিকে নূতন করিয়া একটা হইচই পড়িয়া গেল। ছেলে-বুড়ো স্ত্রী-পুরুষ একেবারো যেন খেপিয়া উঠিল! ভলান্টিয়ারদের চেষ্টায় এতক্ষণ সকলের দর্শন ও প্ৰণাম শৃঙ্খলাবদ্ধ ভাবেই চলিতেছিল, এবার আর কাহাকেও সংযত করা গেল না! যাদব। আর পাগলদিদি। বুঝি পিষিয়াই যান ভিড়ে। পাগলদিদির দুটি পা ঢাকিয়া গেল সিঁদুরে। তারপর ছেলেদের চেষ্টায় জনতা ঠেকাইবার ব্যবস্থা হইলে শয্যা রচনা করিয়া পাশাপাশি দুজনকে শোয়ানো হইল। কায়েতপাড়ার সংকীর্ণ পথে কোনোবার রথ চলে নাই, শীতলবাবুর হ্রকুমে বেলা প্রায় তিনটার সময় বাবুদের রথটি অনেক চেষ্টায় যাদবের গৃহের সম্মুখ পর্যন্ত টানিয়া আনা হইল। পাগলদিদিকে কোনোমতে চোখ মেলানো গেল না, যাদব কষ্টে চোখ মেলিয়া একবার চাহিলেন। চোখের তারা দুটি এখন তাহার আরও ছােটাে হইয়া গিয়াছে। তারপর যাদবও আর সাড়া-শব্দ দিলেন না। সকলে বলিল, সমাধি। পাগলদিদি মারা গেলেন ঘণ্টাখানেক পরে, ঠিক সময়টি কেহ ধরিতে পারিল না। একটি ব্রাহ্মণ সধবা গঙ্গাজলে মুখের ফেনা ধুইয়া দিলেন। যাদবের শেষ নিশ্বাস পড়িল গোধূলিবেলায়। শশীর স্পর্শ করিবার অধিকার নাই! তফাৎ হইতে সে ব্যাকুলভাবে বলিল, ওঁর মুখে কেউ গঙগাজল দিন। * সত্যি-মিথ্যায় জড়ানো জগৎ। মিথ্যারও মহত্ত্ব আছে। হাজার হাজার মানুষকে পাগল করিয়া দিতে পারে মিথ্যার মোহ। চিরকালের জন্য সত্য হইয়াও থাকিতে পারে মিথ্যা। যারা যাদব ও পাগলদিদির পদধূলি মাথায় তুলিয়া ধন্য হইয়াছিল, তাদের মধ্যে কে দুজনেব মৃত্যুরহস্য অনুমান কবিতে পরিবে? চিরদিনের জন্য এ ঘটনা মনে গাঁথা হইয়া রহিল,-“এক অপূর্ব অপার্থিব দৃশ্যের স্মৃতি। দুঃখ যন্ত্রণার সময় এ কথা মনে পড়িবে। জীবন বৃক্ষ নীরস হইয়া উঠিলে এ আশা করিবাব সাহস থাকিবে যে খুজিলে এমন কিছুও পাওয়া যায় জগতে, বাঁচিয়া থাকার চেয়ে যা বড়ো। শোক দুঃখ, জীবনের অসহ্য ক্লান্তি এ সব তো তুচ্ছ, মরণকে পর্যন্ত মানুষ মনের জোরে জয় করিতে পারে। কত সংকীর্ণ দুর্বল চিত্তে যে যাদব বৃহতের জন্য, মৃদু হােক, প্রবল হােক, ব্যাকুলতা জাগাইয়া রাখিয়া গিয়াছেন, শশী তাই ভাবে। যখন ভাবে, তখন আফিমের ক্রিয়ায় যাদবের চামড়া ঢাকিয়া চটচটে ঘাম, বিন্দুর মতো ছোটাে হইয়া আসা চোখের তারকা আর মুখে ফেনা উঠিবার কথা সে ভুলিয়া যায়। বর্ষা আসিয়াছে। খালে জল বাড়িল, ডোবা পুকুর ভরিয়া উঠিল। চারিদিকে কাদা, ডাঙা পথে কোথাও যাওয়া মুশকিল। পালকি-বোহারাদের পা কাদায় ডুবিয়া যায়, খুব ধীরে ধীরে চলিতে হয়। এমনি বৃষ্টিবাদলের মধ্যে একদিন কুসুমের বাবা মেয়েকে লাইতে আসিল। সেইদিন তালপুকুরের ধারে কুসুম কেমন করিয়া পড়িয়া গেল সেই জানে। বলিল, কোমরে চোট লাগিয়াছে আর হাতটা গিয়াছে ভাঙিয়া। কী করে যাব, তোমার সঙ্গে? আমি তো যেতে পারব না বাবা! পুজোর সময় এসে আমায় নিয়ে যেয়ো ।