পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র প্রথম খণ্ড.djvu/৪৪৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

bang labOOKS. in 88や মানিক রচনাসমগ্ৰ কখনও স্বচ্ছলতা আসে, কখনও অভাব দেখা দেয়। টাকা পয়সা সম্বন্ধে বনবিহারী কুমুদের ঠিক বিপরীত। একটি পয়সা সে কখনও ধার করে না। এ বিষয়ে জয়া আরও কঠোর। দুটি পরিবার এক বাড়িতে বাস করিতেছে, কিন্তু তাদেব মধ্যে আলু-পটলের বিনিময়ও জয়া বরদাস্ত করিতে পারে না। একদিন জয়াকে বাড়তি তরকারি দিতে গিয়া মতি যা ঘা খাইয়াছিল, কোনোদিন ভুলিবে না। নষ্ট হবে, ফেলে দেব, তবু নেবে না দিদি ? না রে, না। দেওয়া-নেওয়া আমি ভালোবাসি না। আচ্ছা আচ্ছা, বেশ! আমি যদি কোনোদিন তোমার কাছে এক টুকরো নেবু পর্যন্ত নিই--- কে দিচ্ছে তোকে ? রাগ হইলে মতির গ্ৰাম্যতা প্রকাশ পায়। সে বলিয়াছিল, তোমার বড়ো ছোটাে মন দিদি ! অহংকারে ফেটে পড়ছা! জয়া কিছু বলে নাই। একটু হাসিয়াছিল। মতির রাগকে শুধু নয়, তাহার সমস্ত গ্ৰাম্যতা ও সংকীর্ণতাকেও জয়া হাসিয়া উপেক্ষা কবে। সংকীর্ণতাও মতির এক বিষয়ে নয়। তারা আসিয়া পৌঁছবার আগেই জয়া যে সুযোগ পাইয়া ভালো ঘরখানা বেদখল করিয়াছিল, মতির মনে সে কথা গাঁথা হইয়া আছে। সোজাসুজি কিছু না বলিলেও নিজের অজ্ঞাতে কতবার সে মনের ভাব প্রকাশ করিয়া ফেলিয়াছে। একই রান্নাঘর তাদের, পাশাপাশি উনান। মতি যেদিন ভালো মাছ-তরকারি রাঁধে, সেদিন রান্নাঘরের আবহাওয়া হইয়া থাকে সহজ। কিন্তু জয়া যেদিন রান্নার ঘটায় তাহাকে ছাড়াইয়া যায় সেদিন মতির অস্বস্তির সীমা থাকে না। সে যেন ছোটাে হইয়া যায়। আড়াচােখে আড়াচোখে সে জয়ার রান্না তরকারির দিকে তাকায, মুখখানা কালো হইয়া আসে মতির। বনবিহারী জয়াকে বড়ো ভালোবাসে, যত নির্বক ও নেপথ্য হােক সে ভালোবাসা, মতিরও বুঝিতে বাকি থাকে না। জয়ার কাছে তাই সে আকারে ইঙ্গিতে কুমুদের অসীম ভালোবাসা প্রমাণ করিতে চাহিয়া হাস্যকর অবস্থার সৃষ্টি করিয়া বসে। x জয়া নীরবে হাসে। হাসছ যে দিদি ? হাসব না ? তুই যে হাসাস । মতি গম্ভীর হইয়া বলে, অত হাসি ভালো নয়। জয়ার সঙ্গে খাপ খায় না মতির। মেলামেশা আছে, গল্পগুজব আছে, প্রীতি যেন তবু জমে না। আত্মীয়ার মতো ব্যবহার করিয়াও জয়া যেন অনাত্মীয়া হইয়া থাকে, ছোটো বোনটির মতো তাহার প্রতি নির্ভর রাখিয়া মতি সুখ পায় না। মিলিয়া মিশিয়া যে দিনটা ভালোই কাটে, সেদিনও সন্ধ্যায় মৃদু ক্ষোভের সঙ্গে মনে হয়, সবই তো আছে, ভালোবাসা কই ? আসিবার সময় পথে ট্রেনে একটি বউয়ের সঙ্গে মতির গলায গলায় ভাব হইয়াছিল, এও যেন তেমনই পথের পীরিতি। এত ঘনিষ্ঠতায় সমবেদনার আনন্দ কই? টাকা-পয়সার এবং আরও কয়েকটি সুবিধার জন্যই কি তারা একত্র বাসা বঁধিয়াছে, আর কোনো সম্বন্ধ গড়িয়া উঠিবে না। তাদের মধ্যে ? জয়ার দোষ নাই। কঁচা মনের উচ্ছসিত আবেগে সে যা চায়, খানিকটা উচ্ছাসভরা আদর মমতা, জয়া কেন তা দিতে পরিবে? তার শিক্ষাদীক্ষা অন্য রকম। গেয়ো বলিয়া অবহেলা সে মতিকে করে না, রাধিতে শেখায়, চুল বঁধিয়া দেয়, সদুপদেশ শোনায়, সান্তনা দেয়। ভাবপ্রবণতা জয়ার নাই। মতি তাকে নিষ্ঠুর মনে করে। তা ছাড়া জয়ার মনে একটা গভীর দুঃখ আছে। স্বামীর প্রতিভা তাহার অর্থাভাবে ব্যর্থ হইতে বসিয়াছে। বিবাহ সে করিয়াছিল আর্টিস্টকে, যার ভবিষ্যৎ ছিল ভাস্বর, ঘর সে করিতেছে। পটুয়ার। সমবেদনার প্রয়োজন জয়ার নিজেরও কম নয়। অথচ মতি তার এ দুঃখের স্বরূপ বোঝে না। একদিন