পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র প্রথম খণ্ড.djvu/৪৭৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

bang labOOKS. in 88 মানিক রচনাসমগ্র দেওয়া আর চলে না। মুখখানা শশীব একটু পাংশু দেখাইতেছিল। কী বলা যায় কুসুমকে, কী করা যায়! কে জানিত মোটে দুদিনের নোটিশে কুসুম তাকে এমন বিপদে ফেলিবে, তার গুছানো মনের মধ্যে এমন ওলোট-পালোট আনিয়া দিবে! কুসুমের কাছে বসিয়া থাকিলে, দুদিন পরে সে যে চিরদিনের জন্য চলিয়া যাইবে এই চিন্তার কষ্ট তরঙ্গের মতো পলকে পলকে অবিরাম উথলিয়া উঠিয়া তাকে এমন উতলা করিয়া তুলিবে, এ ধারণা শশীর ছিল না। কাল কথাটা শুনিয়া অবধি শশীর মনে নানা বিচিত্ৰ ভাবধারা উঠিতেছিল, আজ সকালে সে সমস্ত যেন শুধু একটা কটু ক্লেশে পরিণত হইয়া গিয়াছে। কুসুমের যে শরীরটা আজ অপার্থিব সুন্দর মনে হইতেছিল তার সমস্তটা শশী জড়াইয়া ধরিতে পারিল না, হঠাৎ করিল কি, খপ করিয়া কুসুমের একটা হাত ধরিয়া ফেলিল। কুসুম একটু অবাক হইয়া গেল। দুজনের মধ্যে ব্যবধান ছিল, হাতে টান পড়ার জন্যই বোধ হয়। কুসুম একটু সরিয়াও আসিল কিন্তু কথা যা বলিল তা অপূর্ব, অচিন্তিত। কতবার নিজে যেচে এসেছি, আজকে ডেকে হাত ধরা-টরা কি উচিত ছোটােবাবু? রেগে- টেগে উঠতে পারি তো আমি ? বড়ো বেয়াড় রাগ আমার। শুনিয়া শশীব আধো পাংশু মুখখানা প্রথমে একেবারে শুকাইয়া গেল। কে জানিত কুসুমকে এত ভয়ও শশী করে? তবু কুসুমের হাতখানা সে ছাড়িল না। বলিল, রেগো, কথা শুনে রেগো। আমার সঙেগ চলে যাবে বউ ? চলে যাব ? কোথায় ? যেখানে হোক। যেখানে হোক চলে যাই চলো আজ রাত্রে। কুসুম সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিল, না। শশী ব্যাকুলভাবে বলিল, কেন ? যাবে না কেন? কুসুম শুধু বলিল, কেন যাব? শশী বোকার মতো, শিশুর মতো বলিল, কেন যাবে? কেন যাবে মানে কী কুসুম ? আজ নাম ধরে কুসুম বললেন!—বলিয়া ছোটাে বালিকার মতো মাথা দুলাইয়া জ্বলজ্বলে চােখে শশীর অভিভূত ভাব লক্ষ করিতে করিতে কুসুম বলিল, কী করে যে শুধোলেন কোন যাব! আপনি বুঝি ভেবেছিলেন যেদিন আপনার সুবিধে হবে ডাকবেন, আমি আমনি সুড়সুড়ি করে আপনার সঙ্গে চলে যাব ? কেউ তা যায় ? শশী অধীরভাবে বলিল, একদিন কিন্তু যেতে। কুসুম স্বীকার করিয়া বলিল, তা যেতম ছোটােবাবু, স্পষ্ট করে ডাকা দূরে থাক, ইশারা করে ডাকলেও ছুটে যেতাম। চিরদিন কী এক রকম যায় ? মানুষ কী লোহায় গড়া যে চিরকাল সে এক রকম থাকবে, বদলাবে না ? বলতে বসেছি। যখন কড়া করেই বলি, আজ হাত ধরে টানলেও আমি যাব না। তার হাত ছাড়িয়া দিয়া শশী বলিল, তোমার রাগ যে এমন ভয়ানক তা জানতাম না বউ । অনেক বড়ো বড়ো কথা তো বললে, একটা ছোটাে কথা তুমি কেন বুঝতে পার না ? নিজের মন কি মানুয সব সময়ে বুঝতে পারে বউ ? অনেকদিন অবহেলা করে কষ্ট দিয়েছি বলে আজ রাগ করে তার শোধ নিতে চলেছি, এমন তো হতে পারে। আমি না বুঝে তোমায় কষ্ট দিয়েছি, তোমার পরে কতটা মায়া পড়েছে জানতে পারিনি? তুমি চলে যাবে শুনে এতদিনে আমার খেয়াল হয়েছে? তা ছাড়া তোমার কথাই ধরি, তুমি বললে মানুষ বদলায়—বেশ, আমি অ্যাদ্দিন তোমার সঙ্গে খেলাই করেছি, আজ তো আমি বদলে যেতে পারি বউ ?