পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র প্রথম খণ্ড.djvu/৫১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

bang labOOKS. in জননী ○ > মতো উদ্দেশ্যহীন ভাবেই সে ঘুরিয়া বেড়াইয়াছে। কিন্তু এমন সে দুঃসাহসী, কত রাজা রাজ-রাজড়ার সঙ্গে যে খাতিব জমাইয়াছে, পার্থিব সম্পদলাভের সুযোগ কি সে কখনও পায় নাই? পথেঘাটে লোকে তো হিরাও কুড়াইযা পায়! বিষ্ণুপ্রিয়ার বাবা পশ্চিমে গিয়াছিলেন কপৰ্দকহীন অবস্থায়, কোথাকার রাজার সুনজরে পড়িযা বিশ বছর দেওয়ানি করিলেন, দেশে ফিরিয়া দশ বছর ধরিয়া পেনশন পাইলেন। বছরে দশ হাজার টাকার। মামার জীবনে ও রকম কিছুই কি ঘটে নাই ? কোনো দেশের রাজার ছেলের প্ৰাণ-টান বঁাচাইয়া লাখ টাকা দামের পান্না-মরকত একটা-কিছু উপহার ? মামা নিঃস্ব অবস্থায় ফিরিয়া আসিয়াছে শ্যামার ইহা বিশ্বাস করিতে ইচ্ছা হয় না। একবার তাহদের গ্রামে এক সন্ন্যাসী গাছতলায় মরিয়া পড়িয়া ছিল, সন্ন্যাসীর সঙ্গে ছিল পুরু কাঠের ছোট্ট একটি জলচৌকি ; তব ভিতরটা ছিল ফাঁপা, পুলিশ নাকি স্কুর মতো ঘুবাইয়া ছোটোছোটাে পায়া চারটি খুলিয়া তক্তাব ভিতরে একগাদা নোট পাইয়াছিল। মামার ব্যাগের মধ্যে, কোমরের থলিতে হয়তো তেমনি কিছু আছে ? নোট না হােক, দামি কোনো পাথর-টাথর ? মামা স্থায়ীভাবে রহিয়া গেল। ভারী আমুদে মিশুক লোক, কদিনের মধ্যে পাড়ার ছেলেবুড়োর সঙ্গে পর্যন্ত তাহাব খাতিব জমিয়া গেল, এ বাডিতে দাবাব আডিডায় ও বাড়িতে তাসের আডিডায় মামার পাশারের অন্ত বহিল না। মামার প্রতি এখন শীতলের ভক্তি অসীম, মামার মুখে দেশবিদেশের কথা শুনিতে তাতােব আগ্রহ যেন দিনদিন বাড়িয়া চলে, মামাকে সে চুপ করিতে দেয় না। মামা আসিবার পর হইতে সে কেমন অনমনস্ক হইয়া পড়িয়াছে, চোখে কেমন উদাস উদাস চাউনি। শ্যামা একটু ভয় পায়। ভাবে, এবার আবাব মাথায় কী গোলমাল হয়। দ্যাখো ! ঠিক শীতলেব জনা যে শ্যামার ভাবনা হয় তা নয, শীতলেব সম্বন্ধে ভাবিবার তাহার সময় নাই। তাৰ গুছানো সংসারে শীতল কবে কী বিপর্যয আনে এই তার আশঙ্কা। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে একটা অদ্ভুত সম্পর্ক দাঁড়াইয়াছে তাহদের। সংসাব শ্যামার, ছেলেমেয়ে শ্যামার—-ওর মধ্যে শীতলেব স্থান নাই –নিজের গৃহে নিজের সংসারের সঙ্গে শীতলেব সম্পর্ক শ্যামাব মধ্যস্থতায়, গৃহে শীতল শ্যামার আড়ালে পড়িয়া থাকে, স্বাধীনতাবিহীন স্বাতন্ত্রবিহীন জড় পদার্থের মতো। এতদিন শীতল মদ খাইত, শ্যামাকে মারিত, কিন্তু শীতল ছাড়া শ্যামার তখন কেহ ছিল না। আজ শীতলেব মদ খাইতে ভালো লাগে না, শ্যামাকে ম্যবা দূরে থােক ধমক দিতেও তাহার ভয় করে শ্যাম আজ কত উচুতে উঠিয়া গিয়াছে। কোনোদিকে কোনো বিষয়ে খুত নাই শ্যামার, সেবায়-যত্নে, বিধি-ব্যবস্থায়, বুদ্ধি-বিবেচনায়, ত্যাগে, কর্তব্য-পালনে সে কলেবণ মতো নিখুঁত-শ্যামার সঙ্গে তুলনা করিয়া সবসময় শীতলের যেন নিজেকে ছোটোলোক বলিযা মনে হয়, এবং সে যে অপদার্থ ছিটগ্ৰস্ত মানুষ এ তো জানে সকলেই, অন্তত শ্যামা যে জানে শীতলেব তাহাতে সন্দেহ নাই। সবসময় শীতলের মনে হয় শ্যামা মনে মনে তাহার সমালোচনা করিতেছে, তাহাকে ছোটো ভাবিতেছে, ঘুণা করিতেছে- কেবল মাস গেলে সে টাকা আনিয়া দেয় বলিয়া মনের ভাব রাখিয়াছে চাপিয়া, বাহিরে প্রকাশ করিতেছে না। বাহিরের জীবনে বিতৃষ্ণ আসিলে শীতলের মন নীড়ের দিকে ফিরিয়াছিল, চাহিষাছিল শ্যামাকে-কিন্তু সাত বৎসরের বন্ধ্যাজীবন-যাপিনী লাঞ্ছিতা পত্নী যখন জননী হয় তখন কে কবে তাহাকে ফিরিয়া পাইয়াছে? বউয়ের বয়স যখন কঁচা থাকে তখন তাহার সহি২১- না মিলিলে আর তো মিলন হয় না। মন পাকিবার পর কোনো নারীর হয় না। নূতন বন্ধু, নূতন প্রেমিক। দুঃখ মুছিয়া লইবার, আনন্দ দিবার, শান্তি আনিবার ভার শ্যামাকে শীতল কোনোদিন দেয় নাই, শীতলের মনে দুঃখ নিরানন্দ ও অশান্তি আছে কিনা শ্যামা তাহা বুঝিতেও জানে না। শীতল ছিল রুক্ষ উদ্ধত কঠোর, শ্যামাকে সে কবে জানিতে দিয়াছিল যে তার মধ্যেও এমন কোমাল একটা অংশ আছে যেখানে প্রত্যহ প্রেম ও সহানুভূতির প্রলেপ না পড়িলে যন্ত্রণা হয় ? শ্যামা জানে, ও সব প্রয়োজন শীতলের নাই, ও সব শীতল বোঝেও না। তাই ছেলেমেয়েদের