পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র প্রথম খণ্ড.djvu/৮১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

bang labOOKS. in জননী br> বিবৰ্ণ দপ্তর, কাঠের একটি বাকসের সামনে শীর্ণকায় টিকিসমেত একজন মুহুরি। রাখালের মুকুবি ? নিজে সে সামান্য চাকরি করে, মুকুরি দিয়া তাহার কীসের প্রয়োজন ? বাহিরের ঘরখানা দেখিলেই আনন্দেহ হয় রাখালের অবস্থা বুঝি খারাপ নয, অনেকটা উকিল-মোক্তারের কাছারি ঘরের মতো তাহার বৈঠকখানা। বৈঠকখানার পরেই বহিরঙ্গন, সেখানে দুটা বড়ো বড়ো ধানের মরাই। তারপর রাখালের বাসগৃহ, আট-দশটি ছােটােবড়ো টিনের ঘরের সমষ্টি, অধিবাসীদেব সংখ্যাও বড়ো কম নয়। কদিন এখানে বাস করিয়াই শ্যামা বুঝিতে পারিল রাখাল তাহাকে মিথ্যা বলিযাছিল, সে দরিদ্র নয়। মধ্যবিত্তও নয়। সে ধনী। চাকরি রাখাল সামান্য মাহিনাতেই করে। কিন্তু সে অনেক জমিজমা করিয়াছে, বহু টাকা তাহার সুদে খাটে। রাখালেব সম্পত্তি ও নগদ টাকার পরিমাণটা অনুমান করা সম্ভব নয়। তবু সে যে উচুদরের বড়োলোক চোখ কান বুজিয়া থাকিলেও তাঁহা বোঝা যায়। মোটরগাড়ি, দামি আসবাব, গৃহের রমণীবৃন্দের বিলাসিতার উপকরণ গ্ৰাম্য গৃহস্তুের ধনবত্তার পরিচয় নয়, তাহাদের অবস্থাকে ঘোষণা করে পোয্যের সংখ্যা, ধান মরাই, খাতকের ভিড়। রাখালের তিনটি জোড়া তক্তপোশ সকালবেলা খাতকের ভিড়ে ভরিয়া যায়। দেখিয়া শুনিয়া শ্যামা নিশ্বাস ফেলিল। রাগ ও বিদ্বেষ এবাব যেন তাহদের হইল না, অনেক অভিজ্ঞতা দিয়া শ্যামা এখন বুঝিতে পারিয়াছে রাখাল একা নয়, এমনই জগৎ । এমন করিয়া মিথ্যা বলিতে না জাস্পিল ছল ও প্রবঞ্চনায় এমন দক্ষতা না জন্মিলে, সকালে উঠিয়া দশ-বিশটি খাতকের মুখ দেখিবার সৌভাগ্য মানুষের হয় না। রাখালের দোষ নাই। মানুষের মাঝে মানুষের মতো মাথা উচু করিবার একটিমাত্র যে পন্থা আছে তাই সে বাছিযা নিয়াছে। রাখাল তো ধর্মযাজক নয়, বিবাগি সন্ন্যাসী নয়, সে সংসারী মানুষ, সংসাবে দশজনে যে ভাবে আত্মোন্নতি করে সেও তেমনিভাবে অর্থ সম্পদ সঞ্চয় কবিযাছে { শ্যামা সব জানে। বড়োলোক হইবার সমস্ত কলাকৌশল। কেবল স্ট্রীলোক করিয়া ভগবান তাহাকে মাবিয়া রাখিয়াছেন! রাখালের দ্বিতীয় পক্ষের বউ সুপ্ৰভাকে দেখিযা প্রথমে শ্যামা চোখ ফিরাইতে পারে নাই। রাখালোব দু। বার বিবাহ করার কারণটাও তখন সে বুঝিতে পারিয়াছিল। এত বৰূপ দেখিলে মাথার ঠিক থাকে পুরুষ মানুষের! একটি ছেলে আর একটি মেয়ে হইয়াছে সুপ্রভার, শ্যা, আসিবার আগে সে নাকি অনেকদিন অসুখেও ভুগিয়াছিল, তবু এখনও সে ছবির মতো, প্রতিমার মতো সুন্দরী। এমন সতিন থাকিতে মন্দা যে কেমন করিয়া এখানে গৃহিণীর পদটি অধিকার কারযা আছে, চারিদিকে সকলকে কুকুম দিয়া বেড়াইতেছে-সুপ্রভাকে পর্যন্ত, ভাবিয়া প্রথমটা শ্যামা আশ্চর্য হইয়া গিয়াছিল। তারপর সে টের পাইয়াছে যতই বুপ থাক সুপ্রভার বুদ্ধি নাই, বড়ো সে বোকা । পুতুলের মতো সে পরের হাতে নড়ে-চড়ে, সাহস করিয়া যে তাহার উপর কর্তৃত্ব করিতে যায় তারই কর্তৃত্ব স্বীকার করে, একেবারে সে মাটির মানুষ, ঘোরপ্যাচ বোঝে না, নিজের পাওনাগন্ডা বুঝিয়া লইতে জানে না। তবু রাখাল কিনা আজও ছোটোেবড বলিতে অজ্ঞান, মনে মনে সকলেই সুপ্রভাকে ভয় করে, এ বাড়িতে আদরের তাহার সীমা নাই। সুপ্ৰভা প্ৰভুত্ব করার চেয়ে নির্ভর করিতেই ভালোবাসে বেশি, আদরপাওয়াটাই তার জীবনে সবচেয়ে বড়ো প্রাপ্য। মন্দার গৃহিণীপনার ভিত্তিও ওইখানেই --সুপ্রভাকে সে নয়নের মণি করিয়া রাখিয়াছে। কে বলিবে সুপ্ৰভা তাহার। সতিন ? স্নেহে যত্নে সুপ্রভার দিনগুলিকে সে ভরাট করিয়া রাখে, নিজের হাতে সে সুপ্ৰভাকে সাজায়, সুপ্রভাব শয্যা রচনা করিয়া দেয়, সতিনের প্রতি স্বামীর গভীর ভালোবাসাকে হাসিমুখে গ্ৰহণ করে। সতিনের সংসারেও তাই এখানে কলহ বিবাদ মান অভিমান মন কষাকষি নাই। মন্দা ভুলিয়া গিয়াছে সে বধু। এই মূল্য দিয়া সে হইয়াছে গৃহিণী। মানিক ১ম-৬