পাতা:মার্কস ও মার্কসবাদীদের অজ্ঞতা.pdf/১৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১৪
মার্কস ও মার্কসবাদীদের অজ্ঞতা

তাতে আর আশ্চর্য কি? ঠিক সেই রকম ভারতের ভক্তিতত্ত্ব সম্বন্ধে কোনো জ্ঞান না থাকায় মার্কস অবাক হয়ে ভাবেন, কেমন করে “প্রকৃতির সম্রাট মানুষ, হনুমানরূপী বানর বা সাব্বালা (?) রূপী গোরুর পায়ে লুটিয়ে পড়ে!” তবে বরফ গলতে শুরু করেছে। সবে তারা ভারতের ভক্তিবাদের আস্বাদ পেয়ে মাথা মুড়িয়ে খোল করতাল নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় কীর্তন করতে শুরু করেছে। যে জগন্নাথ শব্দ তারা উচ্চারণ করতে পারত না, Jaggernaut বলে হাসি-তামাশা করত, সেই প্রভু জগন্নাথ আজ রথে চড়ে লণ্ডন, নিউইয়র্ক, প্যারিস, সানফ্রানসিস্কো, সিনী বা মস্কোর রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন। এর চেয়ে সুখের আর কি হতে পারে? যারা সংস্কৃত উচ্চারণ করতে পারে না তারাও গাতা, ভাগবৎ আবৃত্তি করছে বা হরে কৃষ্ণ মহানাম জপ করছে। তবে ভারতের জ্ঞানমার্গ বা নিষ্কাম কর্মের মার্গ বুঝতে হয়তো তাদের আরো কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।


মার্কস ও খ্রিস্টধর্ম:

 মার্কস দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন যে, খ্রিস্টধর্মই হল সভ্য সমাজের একমাত্র ধর্ম এবং শ্রেষ্ঠ ধর্ম এবং ভারতে এই ধর্মের প্রসার ঘটাতে পারলে ভারতের অসভ্য জংলী মানুষগুলোর কিছুটা উন্নতি হত— এক কথায় কিছুটা সভ্য হত। তাই তিনি বৃটিশদের দোষারোপ করছেন এবং কৈফিয়ত তলব করে বলছেন, “যখন তারা (ব্রিটিশরা) পবিত্র খ্রিস্টধর্মকে রক্ষার ছুতো দিয়ে ফরাসী বিপ্লবের বিরোধিতা করেছে এবং (ফরাসীদের সঙ্গে) যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে, সেই একই সময়ে তারা ভারতে ঐ ধর্মের ব্যাপক প্রসারে বাধা দেয়নি? বাংলা ও উড়িষ্যার মন্দিরগুলিতে যে সব তীর্থযাত্রীদের সমাগম হয় তাদের কাছ থেকে টাকা কামানোর উদ্দেশ্যে তারা জগন্নাথের মন্দিরে নরবলি ও বেশ্যাবৃত্তির ব্যবসা ফেঁদে বসেনি?” অর্থাৎ মার্কসের মতে ব্রিটিশরা এতই নীচ ও ঘৃণ্য যে তারা ভারতবর্ষের অসভ্য মানুষগুলোকে চিরকালের মতো অসভ্য ও অনগ্রসর করে রাখার হীন উদ্দেশ্যে সেখানে খ্রিস্টধর্মের ব্যাপক প্রসারে বাধা দিয়েছে। শুধু তাই নয়, একই হীন উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে তারা সেখানকার মন্দিরগুলিতে নরবলি, বেশ্যাবৃত্তি ইত্যাদি জঘন্য কাজে উৎসাহ দিয়েছে।

 এখানে একটা ব্যাপার বিশেষভাবে লক্ষণীয়। যে খ্রিস্টধর্মের জন্য মার্কস ওকালতি করছেন, সেই খ্রিস্টধর্ম তাঁর নিজের দেশ জার্মানীতে আবির্ভূত হয়নি। খ্রিস্টধর্ম শুরু হয়েছিল সুদূর প্যালেস্টাইনে। মার্কস কি কখনও অনুসন্ধান করে দেখেছেন যে, খ্রিস্টধর্মের আগমনের পূর্বে জার্মানীতে কি ধর্মমত প্রচলিত ছিল? আর কেমন করে খ্রিস্টধর্ম আসার ফলে অতি দ্রুত তা লুপ্ত হয়ে গিয়েছিল? সমূলে বিনষ্ট হয়েছিল? মার্কসের পক্ষে এটা খেয়াল রাখা উচিত ছিল যে, ভারতের হিন্দুধর্ম বর্বর হোক, জংলী হোক, যাই হোক না কেন, ২০০ বছর ধরে খ্রীস্টধর্মের আক্রমণে বিনষ্ট হয়ে যায়নি। কিংবা তারও আগে ইসলামের বর্বর, নৃশংস আক্রমণকে ৮০০ বছর ধরে প্রতিহত করে সে তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে, লুপ্ত হয়ে যায়নি। অন্তর্নিহিত শক্তির বলেই সে তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পেরেছে। পক্ষান্তরে তাঁর উন্নত খ্রিস্টধর্ম, ইসলামের আক্রমণ প্রতিহত করতে না পারার ফলে স্পেন থেকে লুপ্ত হয়ে গিয়েছিল।