তাঁহাকে যথারীতি নজর প্রদান করিলে, মীরজাফর সমস্ত নগরে বাঙ্গলা, বিহার, উড়িষ্যার নবাব বলিয়া বিঘোষিত হইলেন।
মীরজাফরের মসনদে উপবেশন করার পর, হীরাঝিলের প্রাসাদস্থিত সিরাজউদ্দৌলার ধনাগারলুণ্ঠনের ব্যবস্থা হইল। মীরজাফর, ক্লাইব, তাঁহার সহকারী ওয়াল্শ, কাশীমবাজারের ওয়াট্স, লশিংটন, দেওয়ান রামচাঁদ এবং মুন্সী নবকৃষ্ণ[১] প্রভৃতি সেই কোষাগারলুণ্ঠনের সময় উপস্থিত ছিলেন। সিরাজউদ্দৌলার এই প্রকাশ্য ধনাগারে ১ কোটি ৭৬ লক্ষ রৌপ্যমুদ্রা, ৩২ লক্ষ স্বর্ণমুদ্রা[২], দুই সিন্ধুক অমুদ্রিত স্বর্ণপিণ্ড, ৪ বাক্স অলঙ্কারে ব্যবহারোপযোগী হীরা, জহরত ও ২ বাক্স অখচিত চুণী, পান্না প্রভৃতি প্রস্তরখণ্ড মাত্র থাকার উল্লেখ দেখা যায়। এই প্রকাশ্য ধনাগার ব্যতীত সিরাজউদ্দৌলার অন্তঃপুরস্থ আর একটি ধনভাণ্ডারের কথা কেহ কেহ উল্লেখ করিয়া থাকেন। তৎকালে অর্থশালী ভারতবাসীমাত্রেই নিজ নিজ অন্তঃপুরে একটি স্বতন্ত্র ধনাগার স্থাপন করিতেন। নবাব-বাদশাহের তো কথাই নাই। কথিত আছে যে, সিরাজউদ্দৌলার অন্তঃপুরস্থ ধনাগার মধ্যে ৮ কোটি টাকা সঞ্চিত ছিল। ইংরেজেরা নাকি তাহার কোনও সন্ধান পান নাই। তাহা মীরজাফর, তাহার কর্মচারী আমীর বেগ খাঁ, রামচাঁদ ও নবকৃষ্ণের মধ্যে বিভক্ত হইয়া যায়। রামচাঁদ পলাশীযুদ্ধের সময় মাসিক ৬০ টাকা বেতনে কার্য করতেন; কিন্তু তাহার দশ বৎসর পরে মৃত্যুকালে তাঁহার নগদে ও হুন্ডীতে ৭২ লক্ষ টাকা, ৪০০টি বড় বড় সোনার ও রূপার কলস থাকার উল্লেখ দেখা যায়। তন্মধ্যে ৮০টি সোনার ও অবশিষ্টগুলি রৌপ্যনিমিত। এতদ্ব্যতীত তাহার ১৮ লক্ষ টাকার জমিদারী ও ২০ লক্ষ টাকার জহরতও ছিল। নবকৃষ্ণও মাসে ৬o টাকা বেতন পাইতেন, তিনিও নাকি মাতৃশ্ৰাদ্ধোপলক্ষে ৯ লক্ষ টাকা ব্যয় করিয়াছিলেন।[৩] মীরজাফরের প্রিয়তমা ভার্যা মণি বেগমও হীরাঝিলের প্রাসাদলুণ্ঠনলব্ধ অর্থেই অগাধ সম্পত্তির অধীশ্বরী হন। তাহার যাবতীয় হীরা, জহরত এই লুণ্ঠন হইতেই লব্ধ।
রামচাঁদ ও নবকৃষ্ণ যে-সমস্ত অর্থ পাইয়াছিলেন, যদি ক্লাইব তাহা জানিতে
- ↑ রামচাঁদ আন্দুলরাজবংশের ও নবকৃষ্ণ শোভাবাজার-রাজবংশের আদিপুরুষ।
- ↑ হণ্টার ভ্রমক্রমে ২ কোটি ৩০ লক্ষ স্বর্ণমুদ্রার কথা লিখিয়াছেন।
- ↑ Mutaqherin Trans. Vol. I, p. 773, Note. মহারাজ নবকৃষ্ণের জীবনপ্রণেতা শ্রদ্ধেয় নগেন্দ্রনাথ ঘোষ বলিয়াছেন যে, মার্সম্যান সাহেব ব্যতীত তৎপূর্বে আর কেহ নবকৃষ্ণের ৬০ টাকা বেতন ও মাতৃশ্ৰাদ্ধে ৯ লক্ষ টাকা ব্যয়ের কথা বলেন নাই। ঘোষ মহাশয় অষ্টাদশ শতাব্দীর ঐতিহাসিক উপকরণের যে বিশিষ্টরূপ অনুসন্ধান করিয়াছেন এরূপ বোধ হয় না। তাহা হইলে ঐৰূপ কথা লিখিতে সাহসী হইতেন না। মুতাক্ষরীনের অনুবাদক ঐ কথা বলিয়া গিয়াছেন। ১৭৮৯ খ্রীঃ অব্দে মুতাক্ষরীনের অনুবাদ প্রকাশিত হয়। অনুবাদ কলিকাতায় মুদ্রিত ও প্রকাশিত হইয়াছিল, তৎকালে রাজা নবকৃষ্ণ জীবিত। সুতরাং অনুবাদক ও নবকৃষ্ণ সমসাময়িক। রাজা নবকৃষ্ণের সময় হইতেই যে এ কথা চলিয়া আসিতেছে, তাহাতে সন্দেহ নাই।