পাতা:মুর্শিদাবাদ কাহিনী.djvu/১৪৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

খোশ্‌বাগ

 শ্মশান মুর্শিদাবাদের পরিচয় দিবার জন্য কেবল দুই-একটি সমাধিক্ষেত্র নগরের কোলাহল হইতে দূরে বিক্ষিপ্ত হইয়া বৃক্ষরাজির স্নিগ্ধছায়ায় অদ্যাপি বিরাজ করিতেছে। সমাধিব্যতীত আর কিছুতেই মুর্শিদাবাদের পরিচয় পাওয়ার সম্ভাবনা নাই। মুর্শিদকুলী বল, আলিবর্দী বল, সিরাজ বল, কাহারও কোন সুস্পষ্ট চিহ মুর্শিদাবাদে দেখিতে পাইবে না; কেবল তাঁহারাই সেই শ্মশানক্ষেত্রের এক এক স্থানে শায়িত হইয়া, আপনাদিগের পরিচয় আপনারাই প্রদান করিতেছেন। কিন্তু নীরব, নির্জন সমাধি-উদ্যানের নিবিড় বৃক্ষচ্ছায়া তাহাদিগকে এরূপ ভাবে আবৃত করিয়া রাখিয়াছে যে, সহসা তাহাদিগকে দৃষ্টিপথের পথিক হইতে দেখা যায় না। তাহাদিগের নাম ও গৌরব যেমন দিন দিন কাহিনীতে পর্যবসিত হইতেছে, তাঁহারাও সেইরূপ কমে ক্রমে বৃক্ষচ্ছায়ার অন্ধকারে মিশিয়া যাইতেছেন। প্রভাতে ও সায়াহ্নে কেবল পক্ষিগণ বৃক্ষচ্ছায়ায় বসিয়া কলধ্বনিতে সমাহিত ব্যক্তিদিগকে সাদরসম্ভাষণ করিয়া থাকে এবং যদি কখনও কোন সহৃদয় ব্যক্তি দর্শন-কৌতূহলপরবশ হইয়া তাহাদের অন্ধকারময় প্রকোষ্ঠে উপস্থিত হন, তিনি উদ্যানস্থিত কুসুমবৃক্ষের নিকট হইতে দুই-চারিটি কুসুম প্রার্থনা করিয়া, সমাধির উপর নিক্ষেপ করিয়া চলিয়া যান। আমরা মুর্শিদাবাদের অধীশ্বরগণের ইহা অপেক্ষা অধিকতর অপর কোন সম্মানের বিষয় অবগত নহি। যাঁহাদের নামই একরূপ বিলুপ্ত হইতে বসিয়াছে, তাহাদের প্রতি অধিক সম্মানপ্রদর্শনের প্রয়োজন কি? মৃত ব্যক্তির আত্মা শান্তিপিপাসু। যে-যে স্থানে তাহাদের দেহ সমাহিত আছে, প্রকৃতি সেই সেই স্থানকে পরম শান্তিময় করিয়া রাখিয়াছেন। প্রকৃতিই তাহাদিগকে পবিত্র ও স্নিগ্ধ শাস্তি প্রদান করুন,—তাহার৷ কৃত্রিম সম্মানের প্রার্থী নহেন। সুখের বিষয়, মুর্শিদাবাদে যে-কয়েকটি সমাধিভবন আছে, প্রায় সকলগুলিই নির্জন ও শান্তিময়।

 মুর্শিদাবাদ হইতে দক্ষিণ দিকে ভাগীরথী বাহিয়া গমন করিতে হইলে, লালবাগ নামক স্থানের কিছু দক্ষিণে, ভাগীরথীর পশ্চিম তীবে একটি প্রাচীরবেষ্টিত উদ্যানবাটিকা নয়নপথে পতিত হইয়া থাকে। এই উদ্যানবাটিকা একটি সমাধিভবন। যেখানে সমাধিভবনটি অবস্থিত, তাহাকে সাধারণতঃ লোকে খোশ্‌বাগ কহে। এই খোশ্‌বাগের সমাধিভবনে নবাব আলিবর্দী খাঁ ও হতভাগ্য সিরাজ চিরনিদ্রায় অভিভূত রহিয়াছেন। তাহাদের পার্শ্বে তাহাদের অন্যান্য পরিবারবর্গ অনন্ত শাস্তি উপভোগ করিতেছেন। মহারাষ্ট্রীয় ও আফগানগণের অত্যাচারে জর্জরিত হইয়া, যিনি জীবনে শাস্তি ভোগ করিতে পারেন নাই, অথচ বঙ্গরাজ্যের প্রজাদিগকে শান্তিসুখ আস্বাদন করাইবার জন্য সর্বদা যাহার চেষ্টা ছিল, মুর্শিদাবাদের অলঙ্কার ও আদর্শ নবাব সেই আলিবর্দী খা ঁমহবৎ জঙ্গ এক্ষণে এই বৃক্ষবাটিকার ছায়ায় চির শান্তি লাভ করিতেছেন। পদতলে তাহার মহীয়সী মহিলা শায়িত হইয়া আছেন। আবার যে হতভাগ্য ষড়যন্ত্রকারিগণের