করিতে দিবে না!” অতঃপর কিছুক্ষণ অপেক্ষা করিয়া পুনর্বার বলিয়া উঠিলেন, “না, তাঁহারা তাহা করিবে না, আমি হোসেন কুলী খাঁর মৃত্যুর জন্য অবশ্যই প্রাণ বিসর্জন দিব।” এই কয়েকটি কথা উচ্চারণ করিবামাত্র সেই কৃতান্তদূতস্বরূপ ঘাতক সিরাজের বঙ্গবিখ্যাত রূপলাবণ্যসম্পন্ন দেহষ্টিতে উপর্যুপরি তরবারির আঘাত করিতে লাগিল! সিরাজের উত্তপ্ত শোণিতধারায় বসুন্ধরার বক্ষঃস্থল প্লাবিত হইল! “আমার কৃতকার্যের ফল যথেষ্ট হইয়াছে, হোসেন কুলী খাঁর মৃত্যুর প্রতিশোধ হইল,” এই কথা বলিতে বলিতে বিশ্বনিয়ন্তাকে স্মরণ করির৷ সিরাজ সর্বংসহার ক্রোড়ে নিপতিত হইলেন। এইরূপে কৃতঘ্ন চক্রান্তকারিগণের ষড়যন্ত্রে, বঙ্গের শেষ স্বাধীন নবাব হতভাগ্য সিরাজের জীবনলীলার অবসান হইল।[১]
এই স্থানে আমরা একটি কথা বলিয়া রাখি। সিরাজ মৃত্যুকালে হোসেন কুলী খাঁর মৃত্যুকে একটি ভয়ানক পাপকার্য মনে করিয়াছিলেন; ইহা হইতে তাহার প্রকৃতি কিরূপ ছিল, তাহা বুঝা যাইতেছে। জীবনের মধ্যে সেই ঘটনাটিকেই তিনি কেবল। সর্বাপেক্ষা ভয়াবহ বলিয়া মনে করিয়াছিলেন। নতুবা মৃত্যুকালে তাহার উল্লেখ করিতেন না। আমরা দেখাইয়াছি যে, সিরাজ স্বীয় জননীর কলঙ্কক্ষালনের জন্য আদর্শমহিলা মাতামহীর পরামর্শে উত্তেজিত হইয়া, হোসেন কুলী খাঁকে বধ করিতে আদেশ দেন। যে-ব্যক্তি নিজ জননীর পবিত্রতাপহারীর হত্যাকেও ভীষণ পাপকার্য বলিয়া মনে করিতে পারে, হায়! দেশীয় ও ইংরেজ ঐতিহাসিক পুঙ্গবগণ, তাহার প্রকৃতিকে নিষ্ঠুর ও শয়তানতুল্য বলিয়া বর্ণনা করিতে তোমাদের বিবেকে কি কিঞ্চিোত্র লাগে নাই? এস্থলে সে কথার অধিক আলোচনার প্রয়োজন নাই। সিরাজের এই সৌন্দর্যসারভূত দেহষ্টি অস্ত্রাঘাতে খণ্ড খণ্ড করিয়া, তদীয় শোণিতধারায় নূতন নবাবের অভিষেক ক্রিয়া সংসাধিত হইল। অতঃপর সিরাজের দেহ হস্তিপৃষ্ঠে সমস্ত মুর্শিদাবাদ নগরে পরিভ্রামিত হইল। নিয়তিচক্রের ভীষণ আবর্তনদর্শনে জনসাধারণ বিস্ময়বিহবল হইয়া পড়িল।
মুতাক্ষরীনকার এই সময়ের একটি ঘটনার উল্লেখ করিয়াছেন। তিনি বলেন যে, যে-স্থলে হোসেন কুলী খাঁর হত্যাকাণ্ড সম্পাদিত হয়, সিরাজের দেহবাহী হস্তীটি কোন কারণে সেই স্থলে দণ্ডায়মান হইলে, সিরাজের দেহ হইতে নাকি তথায় দুই চারি বিন্দু রক্তপাত হইয়াছিল।[২]
মুতাক্ষরীনকার প্রকারান্তরে এই ঘটনাটিকে ঈশ্বরকৃত বলিয়া, হোসেন কুলী খাঁর মহত্ত্ব ও সিরাজের নিষ্ঠুরতা প্রতিপাদনের প্রয়াস পাইয়াছেন। এরূপ ঘটনার ভিত্তি। জনপ্রবাদ ব্যতীত আর কিছুই নহে। বাস্তবিক ঐরূপ ঘটিবার যদি সম্ভাবনাও থাকে, এরূপ স্থলে তাহা যে ঘটিতে পারে, ইহা কদাচ বিশ্বাস করিতে পারা যায় না। যে-ব্যক্তি