অতীত গৌরবের স্মৃতি জাতীয় জীবনে সঞ্জীবনীশক্তির সঞ্চার করিয়া দেয়। যেজাতির ইতিহাস অতীত গৌরবে পরিপূর্ণ, সহস্র বৎসর ব্যাপিয়া অধঃপতনের বিশ্বগ্রাসকর আবর্তমধ্যে নিপতিত থাকিলে, তাহারও অভ্যুত্থানের আশা একেবারে বিলয়প্রাপ্ত হয় না। পূর্ব গৌরবের ধ্যান করিতে করিতে তাহার মৃতপ্রায় দেহে এমন এক বৈদ্যুতিক শক্তির আবির্ভাব হয় যে, সেই মহীয়সী শক্তির বলে সে জাতি অধঃপতনের রসাতলস্পর্শী আবর্ত ভেদ করিয়া মস্তক উত্তোলন করে এবং সমস্ত বাধাবিঘ্ন অতিক্রম করিয়া জয়োল্লাসে দিগদিগন্তে ধাবিত হয়। জাতির পূর্বমহাত্মাগণ মেদিনীমণ্ডলে কীর্তিকিরণ বিকীর্ণ করিয়া গিয়াছেন, অধঃপতিত সে জাতির আশালতা চিরউম্মলিত হইবার নহে। কোন না কোন দিন তাহা ফুসফলে শোভাশালিনী হইয়া জাতীয় জীবন-শ্মশান হাস্যময় করিয়া তুলিবে। কিন্তু যে-জাতির আদি, মধ্য, অন্ত সমস্তই অন্ধকারময়, পূর্বগৌরবের কোন নিদর্শন অনুসন্ধান করিলেও সহজে অবগত হওয়া যায় না, সে জাতি কখনও যে উন্নতির উচ্চতম শিখরে আরোহণ করিবে, সেরূপ আশা সুদূরপরাহত। জানি না, বাঙ্গালী জাতির ন্যায় আবহমান কাল হইতে অধঃপতিত এমন জাতি পৃথিবী মধ্যে দ্বিতীয় আছে কিনা।
বাঙ্গলার ইতিহাসপাঠে বাঙ্গালী জাতির পূর্বগৌরবের কোন বিশেষ পরিচয় পাওয়া যায় না। অবশ্য কোন কোন সময়ে দুই-একজন মহাপ্রাণ জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন, কিন্তু সমস্ত জাতির উপর তাহাদের ক্ষমতা দীর্ঘকাল স্থায়ী হয় নাই। জগৎ ব্যতীত রাজনৈতিক ক্ষেত্রে এমন কোন মহাপুরুষের প্রতিভার বিকাশ পায় নাই যে, তিনি সমস্ত জাতীয়-জীবনে মহাশক্তির সঞ্চার করিতে পারিয়াছেন। দুই-চারি জন উদ্ধৃঙ্খল ভৌমিকের কাহিনী ভিন্ন রাজনৈতিক ক্ষেত্রের গৌরব করিবার বাঙ্গালীর পক্ষে আর কিছুই নাই। ধর্ম ও সারস্বত জগতেও যাঁহারা অলৌকিক ব্যাপার সংঘটিত করিয়াছেন, তাহাদের সংখ্যাও এত অল্প যে, একটি বিশাল জাতির পক্ষে তাহাও তাদৃশ অধিক নয় বলিয়াই বোধ হয়। তথাপি সমগ্র জাতির মধ্যে তাহাদের ক্ষমত৷ যতদুর কার্যকরী হইয়াছে, তাহাতে তাহাদের বিষয় লইয়া কিয়ৎপরিমাণে গৌরব করা যাইতে পারে। ফলতঃ বাঙ্গালীজাতির গৌরবের এমন কিছুই নাই, যাহার ধ্যানে তাহার জীবনীশক্তির সঞ্চার হইতে পারে। রাজনীতির বিশাল ক্ষেত্র তাহার পক্ষে চিরমরুভূমি। সেই মরুভূমিতে এক মহান্ বৃক্ষের বীজ উপ্ত হইয়াছিল, কিন্তু তাহাও শাখাপ্রশাখাসমন্বিত হইয়া আশাজনক ফলোৎপাদন করিতে পারে নাই, অধিকন্তু পরিণামে মহাঝটিকাঘাতে সমূলে উৎপাটিত হইয়া যায়। যে-প্রকাণ্ড পুরুষ আপনার রাজনৈতিক প্রতিভা প্রকাশ করিয়া, ইংরেজ জাতির চক্ষুশূল হইয়াছিলেন, আমরা সেই মহারাজ নন্দকুমারেরই কথা বলিতেছি। মহারাজ নন্দকুমারের যেরূপ প্রতিভা ছিল, তাহার পূর্ণ বিকাশ হইলে, বাঙ্গালী জাতির গৌরব করিবার একটা বিষয় হইত।