এদিকে অন্যায়বৃপে পদচ্যুত নবাব মীরজাফর কলিকাতায় আসিয়া বাস করেন। নন্দকুমারের উপর তাহার পূর্বে যে ক্লোধ হইয়াছিল, এক্ষণে তাহার উপশম হয়। তিনি নন্দকুমারকে আপনার সমস্ত দুঃখের কথা ও অত্যাচারের কথা জানাইলে, ক্লমে নন্দকুমারেরও জ্ঞানসন্টার হইতে আরম্ভ হয়। তিনি বুঝিতে পারিলেন যে, ইংরেজেরা এক্ষণে দেশের সর্বময় কর্তী হইয়া উঠিতেছেন; যাহাকে ইচ্ছা তাহাকেই তাঁহারা নবাব করিতেছেন। নবাবের ক্ষমতা দিন দিন হ্রাস হওয়ায়, সমস্তই ইংরেজদিগের একাধিকৃত হইতেছে। ইংরেজদেগের সহিত বহুদিনের সম্বন্ধে তিনি তাঁহাদের সমস্ত চাতুরী ও কৌশল বুঝিতে পারলেন। তিনি বুঝিতে পারিলেন যে, ইংরেজের দেশের রাজা হইতে চলিয়াছেন, মুসলমান রাজত্বেরও প্রায় অবসান ঘটিয়া আসিয়াছে। তাঁহার কাল সিরাজউদ্দৌলাকে সিংহাসনচ্যুত করিয়াছেন, আজ মীরজাফরকে সিংহাসনচ্যুত করিলেন; আবার দুইদিন পরে হয়ত মীর কাসেমেরও সেইরূপ দশা ঘটাইবেন। সুতরাং যাহাতে ইংরেজদিগের এই ক্ষমতা হ্রাস করিতে পারেন, তজ্জন্য তিনি মনোযোগী হইলেন। তিনি জানিয়াছিলেন যে, মুসলমানরাজত্বে হিন্দুদিগের বিশেষতঃ বাঙ্গালীজাতির যেরূপ সুবিধা ছিল, বণিক ইংরেজরাজত্বে সেরূপ হইবার কিছুমাত্র সম্ভাবনা নাই। তাহারা উচ্চপদে স্বজাতি ব্যতীত কখনও বাঙালীকে নিযুক্ত করিবেন না। পদে পদে তাহদের চাতুরী ও বিশ্বাসঘাতকতা দেখিয়া নন্দকুমারের ইংরেজ-অনুরাগের শৈথিল্য জন্মিল। তিনি মীরজাফরকে পুনরায় সিংহাসনে বসাইতে উৎসুক হইলেন। মীরজাফর অপেক্ষা মীর কাসেম যে উপযুক্ত ছিলেন, তাহা তিনি জানিতেন। কিন্তু মীর কাসেম যখন ইংরেজদেগের অনুগ্রহে নবাবী পাইয়াছেন, তখন তিনি সহসা তাহাদের বিরুদ্ধাচরণ করবেন না বলিয়া, তাঁহার বিশ্বাস হইল। যদিও পরে মীর কাসেম ইংরেজদিগের ব্যবহারে অত্যন্ত অসন্তুষ্ট হইয়াছিলেন, তথাপি তাহার হিন্দুদিগের প্রতি তাদৃশ শ্রদ্ধাও ছিল না। এই সকল কারণে তিনি মীরজাফরের পক্ষ অবলম্বন করিয়া, ইংরেজদেগের প্রভুত্বহুসের জন্য উদ্যোগী হইলেন। তিনি মীর কাসেমকেও হস্তগত করিতে চেষ্টা করিয়াছিলেন। আমরা পরে তাহার উল্লেখ করিতেছি।
নন্দকুমার মীরজাফরকে পুনরায় মসনদে বসাইতে চেষ্টা করিতে লাগিলেন। কিন্তু মীরজাফর এতদূর ভৗত ছিলেন যে, নন্দকুমারের পরামর্শে যদি কাহাকেও গোপনে পরাদি লিখিবার আবশ্যক হইত, তিনি পারিয়া উঠিবেন না বলিয়া প্রকাশ করিতেন। সুতরাং নন্দকুমার নিজের স্কন্ধে সমস্ত ভার লইয়া কার্য করিতে উদ্যোগী হইলেন। পূর্বে উল্লিখিত হইয়াছে যে, শাহ আলম তৎকালে বিহারে ছিলেন। নন্দকুমার তদীয় সাহায্যে, ফরাসীদিগের ও অন্যান্য লোকের সহিত ইংরেজপ্রভুত্বনাশের পরামর্শ করিতে লাগিলেন। দুর্ভাগাক্রমে তাহার একখানি পত্র ইংরেজদেগের হস্তগত হয়। এজন্য ভান্সিটার্ট তাঁহার কার্যকলাপ পরিদর্শনার্থ একদল প্রহরী নিযুক্ত করেন