পাতা:মুর্শিদাবাদ কাহিনী.djvu/৩৫৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।
৩৪৮
মুর্শিদাবাদ-কাহিনী

স্পর্শ করিতে পারে নাই, আজ তাহার নিরাশ্রয় হইয়া দীনবেশে অরণ্য ও কুটীরে আশ্রয় লইতে বাধ্য হইলেন। ইহার পর, দেবসেবা, অতিথিসেবা ও ব্রাহ্মণসেবার জন্য যে সমস্ত জমি নিদিষ্ট ছিল, দেবীসিংহ কৌশলপূর্বক তাহাও আত্মসাৎ করিলেন। বহুদিন হইতে যে সমস্ত সম্পত্তির আয় অনাথগণের প্রতিপালনের জন্য ব্যয়িত হইত, যাহার জন্য জমিদারগণের পূর্বপুরুষগণ অক্ষয় পুণ্য ভোগ করিতেছিলেন, আজ জমিদারগণের চক্ষের সমক্ষে হৃদয়হীন রাক্ষস দেবীসিংহ তাহাদের পূর্বপুরুষগণের পুণ্যকীতিগুলির বিলোপ-সাধনে অগ্রসর হইলেন! দীন দুঃখীর মুখের গ্রাস কাড়িয়া লইয়া আপনার ঐশ্বর্য বৃদ্ধির জন্য অগ্রসর হইলেন। হিন্দু হইয়া দেবসম্পত্তি অপহরণ করিয়া নরকের দ্বার উদঘাটন করিবার ইচ্ছা করিলেন!

 অর্থশালী জমিদার ও ভূস্বামীদের লাঞ্ছনার একশেষ করিয়া, নিরীহ প্রজা ও কৃষকগণের উপর, তাহার অত্যাচার-স্রোত প্রবাহিত হয়। যাঁহারা নিদাঘের রৌদ্র, বর্ষার বর্ষণ মাথায় লইয়া, শীতের তুষারপাতের মধ্যেও অতি কষ্টে কিঞ্চিৎ শস্য সঞ্চয় করে, যাঁহারা স্বচ্ছন্দ-বনজাত শাক ও কঙ্করমিশ্রিত লবণের সহিত দুই এক গ্রাস অন্ন মুখে দিয়া জীবন অতিবাহিত করিয়া থাকে, শতছিদ্রযুক্ত পর্ণকুটীর যাহাদের একমাত্র আশ্রয়স্থল, দেবীসিংহের অত্যাচার হইতে তাঁহারাও নিষ্কৃতি পাইল না। এই সকল লোকদিগের অত্যাচারে কিরূপ অর্থলাভের সম্ভাবনা, তাহা দেবীসিংহ নিজেই ব্যক্ত করিয়াছেন। তিনি এইরূপ লিখিয়াছিলেন, “ইহা অত্যন্ত বিড়ম্বনার বিষয় যে, বাঙ্গলার অন্যান্য স্থান অপেক্ষা রঙ্গপুর প্রদেশের কৃষকদিগের মধ্যেই ঘোর অন্নকষ্ট উপস্থিত হইয়াছে। শস্য কাটার সময় ব্যতীত অন্য কোন সময়ে তাহাদের ঘরে কোনরূপ সম্পত্তি পাওয়া যায় না; কাজেই তাহাদিগকে অন্য সময়ে অতি কষ্টে আহারের উপায় করিতে হয় এইজন্য দুর্ভিক্ষে বহুসংখ্যক লোেক কাল-কবলে পতিত হইতেছে। দুই একটি মৃৎপাত্র ও একখানি পর্ণকুটীর মাত্র তাহাদের সম্বল; ইহাদের সহস্রখানি বিক্রয় করিলেও দশটি টাকা পাওয়া যায় কি না সন্দেহ।” কিন্তু সেই মহাপ্রভু এই সকল দরিদ্র পর্ণকুটীরবাসিগণের প্রতিও নিজ ক্ষমতা প্রকাশ করিতে বুটি করেন নাই। সামান্য গোপাল মেষপালের ন্যায় কৃষিজীবিগণ দলে দলে শৃঙ্খলাবদ্ধ হইয়া, কারাগারে প্রেরিত হইল; তাহার উপর অবিরত বেত্রাঘাতে তাহাদের অঙ্গ ক্ষত-বিক্ষত হইতে লাগিল। অধিকাংশ লোক পলায়ন করিতে আরম্ভ করিল। অপূর্ণলোচনে সকলে প্রিয় বাসস্থান পরিত্যাগ করিয়া, অরণ্যে আশ্রয় লইতে বাধ্য হইল। ক্রমে ক্রমে সমস্ত দেশ মহাশ্মশানের ন্যায় হইয়া দাঁড়াইল। যাঁহারা অবশিষ্ট রহিল, তাহাদের নিকট হইতে সমস্ত টাকা আদায়ের চেষ্টা হইতে লাগিল।

 এই সময়ে রঙ্গপুর অঞ্চলে কতকগুলি রাক্ষস প্রকৃতির কুসীদজীবী বাস করিতেছিল। মহাকবি সেপীয়রের বণিত শাইলকও তাহাদের সমকক্ষ ছিল না। কৃষিজীবিগণ অসহনীয় কষ্টে পতিত হইয়া, তাহাদের নিকট আপনাদের জমাজমি