পাতা:মুর্শিদাবাদ কাহিনী.djvu/৩৫৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।
৩৫০
মুর্শিদাবাদ-কাহিনী

অধিক কষ্ট বোধ না করে, এই ভাবিয়া সেই কৃতান্তের অনুচরেরা কষ্টকপূর্ণ বিশাখার দ্বারা তাহাদের ছিন্ন ভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ আরও ক্ষত-বিক্ষত করিত; তাহার উপর বিছুটির আঘাত করিয়া অপরিসীম যন্ত্রণায় তাহাদিগকে মৃতকল্প করিয়া তুলিত। রাত্রিতেও তাহাদিগের নিস্তার ছিল না। প্রত্যেক রাত্রিতে তাহাদিগকে তিন বার করিয়া বেত্রাঘাত করার নিয়ম ছিল। পরে তাহাদিগকে প্রবল শীতে, নগ্ন দেহে দণ্ডায়মান করিয়া রাখা হইত। প্রভাত হইলে, তুষারশীতল জলে নিমজ্জিত করিয়া, পুনর্বার বেত্রাঘাত করিতে করিতে, গ্রামমধ্যে লইয়া গিয়া, লুক্কায়িত অর্থের জন্য পীড়াপীড়ি করিত। বৃক্ষতলব্যতীত যাহাদের অবলম্বন নাই, তাঁহারা অর্থ কোথায় পাইবে, ইহাও কি পিশাচদিগের মনে উদয় হইত না? তাহার পর আবার কারাগারে প্রেরণ।

 ক্রমে কমে নূতন নূতন অত্যাচারের উদ্ভাবন হয়। পিতার সম্মুখে তাহার স্নেহপুত্তলী শিশুসন্তানকে রজুবদ্ধ করিয়া তাহার সুকোমল দেহে ক্রমাগত বেত্রাঘাতের লীলা চলিতে থাকিত। সেই বেত্রাঘাতে বালকগণের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হইয়া, রুধিরলস্রোতে পিতার মুখমণ্ডল প্লাবিত করিত। পুত্র যন্ত্রণায় এবং পিতা হৃদয়ভেদী দৃশ্যে মূছিত হইয়া, ভূতলে পড়িয়া যাইত। কখন কখন পিতাপুত্রকে একত্র রজ্জবদ্ধ করিয়া, গাত্রে একসঙ্গে বেত্র ও যষ্টির আঘাত পড়িত; পিতা যাহাতে পুত্রের অঙ্গে আঘাত না লাগে এবং পুত্র যাহাতে পিতার শরীর ক্ষত বিক্ষত না হয়, তজ্জন্য চেষ্টা পাইত; কিন্তু উভয়েই সমানরূপে আহত হইয়া, রুধিরাপ্লত দেহে বায়ু-বিকল্পিত অশ্বখপত্রের ন্যায় অবিরত কাপিতে থাকিত।[১]

 এই ত গেল পুরুষদিগের প্রতি অত্যাচারের কথা! তাহার পর স্ত্রীলোকদিগের প্রতি যেরূপ লোমহর্ষণ অত্যাচার হইত, তাহা স্মরণ করিতে গেলেও হৃদয় কাপিয়া উঠে। যে দেশের কুমারীগণকে বিশ্বজননী ভগবতী বলিয়া পূজা করা হইয়া থাকে, সেই সমস্ত কুমারীদিগকে তাহাদের পবিত্র নিকেতন হইতে বলপূর্বক প্রকাশ্য বিচারালয়ে আনয়ন করিয়া, তাহাদের পবিত্রতা নষ্ট করা হইত। যে ধর্মাধিকরণে বসিয়া বিচারক ধর্ম সংস্থাপন করেন, সেই বিচারালয়ে প্রকাশ্য দিবালোকে কুলকামিনীর পবিত্রতা অপহৃত হইতে লাগিল। কুমারীগণের আর্তনাদে, তাহাদের আত্মীয়গণের হাহাকারে দিল প্রতিধ্বনিত হইল! কিন্তু কে তাহাদের কথায় কর্ণপাত করে? যেখানে ন্যায় ও ধর্মের মূতিমান অবতারগণ উপবেশন করিয়া থাকেন, তাঁহারা জানিত না যে, সেই পবিত্র স্থানে ওয়ারেন হেস্টিংসের প্রেরিত কতকগুলি শয়তান বসিয়া আছে। স্বামীর অঙ্ক হইতে পত্নীকে কাড়িয়া আনা হইত। এই সময়ে কত স্ত্রীলোকের যে সতীত্ব নষ্ট হইয়াছে তাহা কে বলিতে পারে? সেই সমস্ত স্ত্রীলোকদিগকে সাধারণের সমক্ষে উলঙ্গিনী করিয়া, অবিরত বেত্রাঘাত করা হইত! লজ্জায়, যন্ত্রণায়, তাঁহারা

  1. এই সমস্ত অত্যাচারের কাহিনী কেবল বার্ক নহেন মিঃ আনথারও ওয়েস্টমিনিস্টার মহাসভায় বিশদরুপে বিবৃত করিয়াছিলেন। (Debrett's Trial of W. H., Part II, p. 3)