পাতা:মুর্শিদাবাদ কাহিনী.djvu/৩৫৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।
দেবীসিংহ
৩৫৩

 যখন এইরূপ করবৃদ্ধির অত্যাচারের সহিত প্ৰজাদিগের স্ত্রী, পুত্র পরিবারের প্রতি ভীষণ পাশবিক অত্যাচারের স্রোত প্রবাহিত হইতে লাগিল, যখন প্রজাগণ আরণ্য পশুর ন্যায় দলে দলে, বনে বনে ভ্রমণ করিয়াও অত্যাচারের হস্ত হইতে নিষ্কৃতি পাইল না, আপনাদিগের সম্মুখে দিন দিন স্বীকন্যার পবিত্রতা অপহৃত এবং অমিমুখে আপনাদের কুটীরগুলি ভস্মীভূত হইতে দেখিতে লাগিল, তখন তাঁহারা স্থির থাকিতে পারিল না। সামান্য পিপীলিকাকে পদদলিত করিলে সেও দংশন করিতে উদ্যত হয়। সুতরাং সেই সমস্ত ভীষণ অত্যাচারে জর্জরিত হইয়া উত্তরবঙ্গের প্রজাগণ ঘাের বিদ্রোহের অবতারণা করিল। তাঁহারা কিছুতেই করপ্রদানে স্বীকৃত হইল না; অবশেষে তাঁহারা অস্ত্রধারণ করিয়া, দেবীসিংহের অনুচরবর্গকে প্রতিনিয়ত আক্রমণ করিতে লাগিল। ১৭৮৩ খ্রীঃ অব্দের জানুয়ারি মাসে কাজীর হাট, কাকিনা, টেপা ও ফতেপুর চাকলার প্রজারা বিদ্রোহী হইয়া, কুচবিহার ও দিনাজপুরের প্রজাদিগকে তাহাদের সঙ্গে যােগ দিবার জন্য আহ্বান করে। নায়েব, গােমস্তা ও অন্যান্য কর্মচারীদিগকে যেখানে দেখিতে পাইল, সেইখানে হত্যা করিল। টেপা প্রভৃতি স্থানের নায়েব তাহাদের হস্তে প্রাণ পরিত্যাগ করিতে বাধ্য হয়। ইহাদের মধ্যে নুরুলউদ্দীন নামে একজন আপনাকে নবাব বলিয়া ঘােষণা করিয়া, দয়াশীল নামে আর একজনকে তাহার দেওয়ান নিযুক্ত করে। এইরূপে তাঁহারা সমস্ত প্রদেশে ভীষণ বিদ্রোহের অভিনয় দেখাইয়াছিল। দেবীসিংহ অত্যন্ত ব্যাকুল হইয়া, রঙ্গপুরের তদানীন্তন কালেক্টর গুড়শ্যাডের শরণাপন্ন হইলেন।

 আমরা পূর্বে বলিয়াছি যে, গুডল্যাডের সহিত দেবীসিংহের বিলক্ষণ বন্ধুতা ছিল। তিনি দেবীসিংহের অনুরােধে প্রজাদিগকে দমন করিবার জন্য কয়েক দল সিপাহী প্রেরণ করিলেন। লেপ্টনান্ট ম্যাকডােনাল্ড উত্তর দিকে এবং আর একজন সুবেদার দক্ষিণ দিকে প্রেরিত হইল। প্রজারা ইহা শুনিয়া, ডিমলার জমিদার গৌরমােহন চৌধুরীর নিকট আশ্রয় লইতে যায়। কিন্তু চৌধুরী তাহাদিগকে রক্ষা। করিবার চেষ্টা করায়, একটা ভীষণ কলহ উপস্থিত হয়। তাহাতে গৌরমােহনের। মৃত্যু ঘটে। কোম্পানীর সৈন্যগণ যাহাকে সমুখে দেখিতে পাইল, তাহাকেই বন্যপশুর ন্যায় গুলি করিতে করিতে অগ্রসর হইল। মােগলহাট ও পাটগ্রাম নামক স্থানে তাহাদিগের সহিত প্ৰজাদিগের দুইটি ক্ষুদ্র যুদ্ধ হইয়াছিল। মােগলহাটের যুদ্ধে দয়াশীল নিহত ও নুরুলউদ্দীন গুরুতর আঘাত প্রাপ্ত হয় এবং সেই আঘাতেই অল্পদিন পরেই তাহার ইহজীবনের লীলা শেষ হয়।[১] দলে দলে প্রজাদিগকে বন্দী করিয়া, কোম্পানীর সিপাহীগণ বিজয়গৌরবে রঙ্গপুরে আসিয়া উপস্থিত হইল। দেবীসিংহের অত্যাচার হইতে প্রজাগণের যাহা কিছু রক্ষা পাইয়াছিল, এক্ষণে সমস্তই

  1. Glazier's Report on Rungpore (Appendix, Goodlad's Report of Insurrection), pp. 68-71.