করিতেছিলেন। তিনি এইরূপ মনে করিয়াছিলেন যে, রঙ্গপুরে উপস্থিত হইতে পারিলে, নিজের সমস্ত ঘটনা অন্ধকারাবৃত করিতে পারিবেন; তাহার সে আশা পূর্ণ হইল।
দেবীসিংহ কলিকাতায় যেরূপভাবে থাকিতেন, রংপুরেও সেইরূপভাবে উপস্থিত হইলেন। পূর্বে যে সকল প্রহরীদ্বারা বেষ্টিত হইয়া, তিনি রঙ্গপুর হইতে কলিকাতায় গমন করিয়াছিলেন, এক্ষণে তাঁহারা তাহার সম্মানের অঙ্গ হইয়া তাহার সহিত পুনর্বার রঙ্গপুরে আসিল। রঙ্গপুরের লোকেরা দেবীসিংহকে আবার দেশের শাসনকর্তার ন্যায় আসিতে দেখিয়া নিতান্ত ক্ষুব্ধ ও শঙ্কিত হইল। প্যাটারস দেবীসিংহকে ঐরূপভাবে থাকিতে দেখিয়া এবং প্রজাদিগের মনে ভীতির সঞ্চার বুঝিতে পারিয়া কলিকাতা কাউন্সিলে লিখিয়া পাঠাইলেন। কাউন্সিলের সভ্যগণ বিষম সমস্যায় পড়িলেন। তাঁহারা একেবারে দেবীসিংহকে বিনা প্রহরীতে রাখা। সঙ্গত মনে করিলেন না, অথচ অপরাধীর ন্যায় প্রহরী নিযুক্ত করিলেও সাধারণ লোকে তাহার অবমাননা করা হইয়াছে মনে করিবে; এই সমস্যার সিদ্ধান্তের জন্য তাঁহারা দেবীসিংহকে প্রহরিবেষ্টিত হইয়া থাকিতে আদেশ দিলেন বটে, কিন্তু তাহাদের বন্দুক ও বেয়নেট নিম্নভিমুখে রাখিবার আজ্ঞা প্রদান করিয়া পাঠাইলেন। তাহার পর কমিশনারগণ প্যাটারসনুকে আপনাদের নিকট হইতে দূরে থাকিতে অনুরোধ করিলেন; কিন্তু দেবীসিংহকে সর্বদা আপনাদিগের মধ্যে রাখিয়া অনুসন্ধান চালাইতে লাগিলেন। এই অনুসন্ধানের ফলে যাহা হইবার তাহাই হইল। দেবীসিংহ দেওয়ানী আদালতে অভিযুক্ত না হইয়া, ফৌজদারী বিচারালয়ে সমপিত হইলেন।
এই সময়ে মহম্মদ রেজা খা ঁফৌজদারী আদালতের বিচারক ছিলেন। তাঁহারই প্রতি দেবীসিংহের বিচারের ভার পতিত হয়। মহম্মদ রেজা খার সহিত দেবীসিংহের কিরূপ বাধ্যবাধকতা ছিল, তাহা পূর্বে উল্লিখিত হইয়াছে; সুতরাং তাহার বিচারে দেবীসিংহ অপরাধমুক্ত হইয়া নিষ্কৃতি পাইলেন। কোম্পানীর রাজত্বে লোকে সুবিচার দেখিয়া অবাক্ হইল। নরহন্তা পরম্বাপহারক শয়তান মুক্তি পাইল। ন্যায় ও ধর্ম মলিনমুখে বঙ্গভূমি হইতে চিরবিদায় গ্রহণ করিলেন! উক্ত কমিশনের ফলে দেবীসিংহ। নিষ্কৃতি পাইলেন বটে, কিন্তু তাহার দেওয়ান হররাম একেবারে নিষ্কৃতি পায় নাই। তাহার প্রতি এক বৎসরের কারাবাসের দণ্ডাজ্ঞা দিয়া, রঙ্গপুর ও দিনাজপুর প্রদেশ হইতে তাহাকে বহিষ্কৃত করা হয়।
কমিশনারদের তদন্তে কতকগুলি নিরীহ প্রজাও বিদ্রোহী হইয়াছিল বলিয়া নির্বাসিত হয়। দেবীসিংহ ও হররাম যে সমস্ত জমিদারী নীলাম করাইয়া আপনার কিনিয়া লইয়াছিলেন, তৎসমুদায়ের কতক কতক প্রত্যর্পণ করা হয়। হররাম যাহাদিগকে শারীরিক যন্ত্রণা দিয়া অর্থ আদায় করিয়াছিল, তাহাদিগকে কিছু কিছু অর্থ প্রদান করা হয়।