বঙ্গাধিকারী
খ্রীস্টীয় চতুর্দশ শতাব্দীর মধ্যভাগে বাঙ্গরাজ্য দিল্লীসাম্রাজ্য হইতে বিচ্ছিন্ন হয়। তাহার পর সুপ্রসিদ্ধ শেরশাহ বাঙ্গলা ও দিল্লী অধিকার করিয়া সমস্ত উত্তর ভারতবর্ষে আপনার জয়পতাকা উড্ডীন করেন। শেরশাহের পর বাঙ্গলা আবার কিছুদিন স্বাধীন ভাব অবলম্বন করে। অবশেষে মোগলকেশরী আকবরশাহ তাহাকে দিল্লীসাম্রাজ্যের। অন্তভূর্ত করিয়া লন। শেরশাহ হইতে বাঙ্গলার রাজস্বসম্বন্ধীয় বন্দোবস্তের কথা বিশদরূপে অবগত হওয়া যায়; আকবরের সময়ে ইহা পূর্ণতা লাভ করে। আকবরের রাজস্ববন্দোবস্ত শেরশাহের প্রথা হইতে গৃহীত বলিয় বিবেচিত হয়।[১] রাজা তোডরমল্ল এই বন্দোবস্তের অধিনায়ক। তিনি ১৫৮২ খ্রীঃ অব্দে বাঙ্গলার জমিদারদিগের সহিত রাজস্বের বন্দোবস্ত করিয়া সমস্ত বঙ্গভূমি ১৯ সরকার ও ৬৮২ পরগণায় বিভক্ত করেন। তাহার রাজস্ববন্দোবস্ত বা আসল তোমর জমা, খালসা ও জায়গীরসমেত প্রায় ১ কোটি ৭০ লক্ষ টাকায় ধার্য হইয়াছিল। তোডরমল্লের পরে শাহসুজা-কর্তৃক আর একবার বাঙ্গলার রাজস্বের বন্দোবস্ত হয়; তৎপরে মুর্শিদকুলী খাঁর সময়ে ইহা উন্নতির চরম সীমায় উপনীত হয়। এই রাজস্ব-সংক্রান্ত বন্দোবস্তের জন্য তোডরমল্ল ভিন্ন ভিন্ন কাননগো নিযুক্ত করিয়াছিলেন; তাহাদের উপরে এক এক জন প্রধান কাননগোও নিযুক্ত হন। কাননগো পদ তোডরমল্লের নূতন সৃষ্টি নহে। তাহার পূর্ব হইতেও বাঙ্গলাদেশে কাননগো পদের উল্লেখ দেখা যায়।[২] তাহার সময়ে উপদের কার্যবিভাগ অতি সুচারুরূপে নিদিষ্ট হয়।
যে বঙ্গাধিকারিগণ বাঙ্গলার প্রধান কাননগে৷ পদে প্রতিষ্ঠিত থাকিয়া বঙ্গরাজ্যের রাজস্বের কার্য অতি দক্ষতার সহিত নির্বাহ করিয়াছিলেন, এইরূপ প্রবাদ আছে যে, তাহাদের পূর্বপুরুষ ভগবান্ রায়, রাজা তোডরমল্লের রাজস্ববন্দোবস্তের সময় প্রধান
- ↑ Elphinstone's History of India (5th edition), p. 541.
- ↑ বাঙ্গলায় দ্বাদশ ভৌমিকগণের সর্বশ্রেষ্ঠ রাজা প্রতাপাদিত্যের পূর্বপুরুষগণ কাননগোবিভাগে কার্য করিতেন। বলা বাহুল্য, তাঁহারা বাজা তোডরমল্লের অনেক পূর্ববর্তী। তাহাদের আদিপুরুষ রামচন্দ্র রায় প্রথমতঃ সপ্তগ্রামে কাননগো-দপ্তরে নিযুক্ত হন। তথা হইতে তিনি গৌড়ে গমন। করিলে, তথায়ও কাননগো-দপ্তরে নিযুক্ত হইয়াছিলেন। তাঁহার কনিষ্ঠ পুত্র শিবানন্দ স্বীয় কার্যদক্ষতাগুণে গৌড়ের বাদশাহ সোললমানের অনুগ্রহে কাননগো-দপ্তরের অধ্যক্ষের পদে নিযুক্ত হন। সোলেমানের পুত্র দায়ুদের সময় শিবানন্দের ভ্রাতুস্পুত্র, শ্রীহরি ও জানকীবল্লভ যথাক্রমে প্রধান মন্ত্রীর ও রাজবিভাগের সর্বোচ্চ পদ প্রাপ্ত হইয়া বিক্রমাদিত্য ও বসন্তরায় উপাধি লাভ করেন। বিক্রমাদিত্যই রাজা প্রতাপাদিত্যের পিতা। দায়ুদের ধ্বংসের পর তোডরমল, বিক্রমাদিত্য ও বসন্তরায়ের নিকট হইতে রাজা-সংক্রান্ত যাবতীয় কাগজপত্র প্রাপ্ত হইয়াছিলেন। তাঁহারা সরকারের কার্য করিতে অস্বীকৃত হওয়ায়, তোডরমল্ল বাদশাহের নিকট হইতে রাজোপাধি আনয়ন করিয়া তাহাদিগকে ভূষিত করেন। (রামরাম বসু প্রণীত প্রতাপাদিত্যচরিত।)