কিরীটেশ্বরী
বর্তমান মুর্শিদাবাদ নগরের প্রান্তদেশ বিধৌত করিয়া যে-স্থলে প্রসন্নসলিলা ভাগীরথী প্রবাহিতা হইতেছেন, যথায় নগরস্থ সহস্রদ্বার সৌধাদির প্রতিবিম্ব নদীবক্ষে পতিত হইয়া রমণীয় শোভা সংবর্ধন করিতেছে, তাহারই অপর পারে ডাহাপাড়ানামক একটি পল্লীগ্রাম অবস্থিত। ডাহাপাড়া ভাগীরথীর পশ্চিমতীরস্থ। এককালে এই ডাহাপাড়া মুর্শিদাবাদ-রাজধানীর অন্তর্গত হইয়া, বহুসংখ্যক অট্টালিকায় বিভূষিত ছিল। তৎকালে মুর্শিদাবাদ ভাগীরথীর উভয় তীরে অবস্থিতি করিয়া, আপনার গৌরব ও সমৃদ্ধি সমগ্র জগতে ঘোষণা করিত। উক্ত ডাহাপাড়া হইতে প্রায় সার্ধ ক্রোশ পশ্চিমে একটি ক্ষুদ্র পল্লী দৃষ্ট হয়; তাহার নাম কিরীটকণা।[১] কিরীটকণা এক্ষণে জঙ্গল-পরিপূর্ণ। কিন্তু ইহার এমন একটি মোহিনী শক্তি আছে যে, তথায় উপস্থিত হইবামাত্র মনঃপ্রাণ শান্তভাবে পরিপূর্ণ হইয়া যায়,—কি এক অনির্বচনীয় রসে অন্তরাত্মা আপ্লুত হইয়া উঠে! স্থানটি জঙ্গলময় হইয়াও যেন শান্তিনিকেতন; শান্তিদেবী যেন ইহাতে চির আবাস-স্থান স্থাপন করিয়াছেন। মুর্শিদাবাদের মধ্যে এরূপ বৈরাগ্যোদ্দীপক স্থান অতি বিরল। এই স্থানে কতিপয় প্রাচীন মন্দির জীর্ণবস্থায় থাকিয়া, মুর্শিদাবাদের পূর্বগৌরবের কথা স্মৃতিপথে জাগাইয়া দেয়। কিরীটকণা মুর্শিদাবাদের মধ্যে একটি প্রাচীন স্থান। এইরূপ প্রবাদ আছে যে, দক্ষযজ্ঞে বিশ্বজননী পতিপ্রাণা সতী প্রাণত্যাগ করিলে, ভগবান বিষ্ণু তাহার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করিয়া সমস্ত ব্রহ্মাণ্ডে নিক্ষেপ করিয়াছিলেন, সেই সময়ে দেবীর কিরীটের একটি কণা এই স্থলে পতিত হয়; তজ্জন্য ইহা উপপীঠ মধ্যে গণ্য এবং ইহার অধিষ্ঠাত্রী কিরীটেশ্বরী বলিয়া এতদঞ্চলে কীর্তিতা।[২] কিরীটেশ্বরী যেন সমস্ত মুর্শিদাবাদেরই অধিষ্ঠাত্রীস্বরূপা ছিলেন। যত দিন তাঁহার গৌরব ছিল, তত দিনই মুর্শিদাবাদের শ্রীবৃদ্ধি, অথবা মুর্শিদাবাদের শ্রীবৃদ্ধি-লয়ের সঙ্গে সঙ্গেই তিনিও এতদঞ্চল হইতে অন্তহিত হইতে বসিয়াছেন। কিরীটকণা প্রথমাবস্থায় ঘোর জঙ্গলে পরিপূর্ণ ছিল; কেবল একটিমাত্র সামান্য মন্দির ইহাতে ভগ্নাবস্থায় দৃষ্ট হইত; উহা কতদিনের নির্মিত, তাহা
- ↑ এই কিরীটকণাকে রিয়াজুস্-সালাতীন-নামক গ্রন্থে ‘তীরতকোণা’ নামে অভিহিত করা হইয়াছে। (Riyaz-us-salatin Asiatic Society's Edition. p. 343.) মেজর রেনেলের কাশীমবাজার দ্বীপের মানচিত্রেও Teretcoona লেখা আছে। কিন্তু ইহার প্রকৃত নাম কিরীটকণা; অদ্যাপি সে গ্রাম বর্তমান রহিয়াছে।
- ↑ তন্ত্রচূড়ামণির পীঠনির্ণয়ে কিরীটে কিরীটপতনের কথা লিখিত আছে। উক্ত গ্রন্থের মতে কিরীটের দেবতার নাম বিমলা ও ভৈরবের নাম সম্বর্ত। কিরীট ৫১ পীঠের অন্যতম; কিন্তু তথায় কোন অঙ্গ পতিত না হইয়া অলঙ্কার পড়ায় কাহারও কাহারও মতে তাহা উপপীঠরূপে গণ্য। মহানীলতন্ত্রে কিরীটের দেবীর নাম কিরীটেশ্বরীই লিখিত আছে। মুর্শিদাবাদের ইতিহাসের প্রথম অধ্যায় দুষ্টব্য।