কাহারও জ্ঞানগোচর ছিল না।[১] উপপীঠ ও জঙ্গলময় বলিয়া মধ্যে মধ্যে দুই-একজন সন্ন্যাসী ব্রহ্মচারী তথায় আগমন করিতেন; পরে ক্রমে ক্রমে মায়ের পূজার বন্দোবস্ত হয়। মহাপ্রভু চৈতন্যদেবের সমসাময়িক মঙ্গলবৈষ্ণব এবং তাঁহার পূর্বপুরুষগণ কিরীটেশ্বরীর সেবক ছিলেন বলিয়া শ্রুত হওয়া যায়।[২] কিন্তু যৎকালে বঙ্গাধিকারিগণ বাঙ্গলা, বিহার ও উড়িষ্যা প্রদেশত্রয়ের প্রধান কাননগো পদে প্রতিষ্ঠিত হন, সেই সময় হইতে কিরীটেশ্বরীর মহিমা চতুর্দিকে বিস্তৃত হইয় পড়ে এবং কিরীটকণার প্রাচীন মন্দির সংস্কৃত হইয়া বর্তমান প্রধান মন্দিরগুলিও নির্মিত হয়।
বঙ্গাধিকারিগণের মতে তাঁহাদের আদিপুরুষ ভগবান রায়, মোগলকেশরী দিল্লীশ্বর আকবর শাহকে স্বীয় কার্যদক্ষতায় পরিতুষ্ট করিয়া বাঙ্গলা, বিহার ও উড়িষ্যার কাননগো পদ ও ‘বঙ্গাধিকারী মহাশয়’ উপাধি লাভ করেন। কিন্তু ভগবান রায় শাহ সুজার সময়ে উক্ত পদে নিযুক্ত হইয়াছিলেন বলিয়া অনুমান হয়। ভগবানের মৃত্যুর পরে তাঁহার কনিষ্ঠ ভ্রাতা বঙ্গবিনোদ রায় কাননগো পদ ও সম্রাটের নিকট হইতে অনেক লাখেরাজ ও দেবোত্তর সম্পত্তি পারিতোষিক-স্বরূপ প্রাপ্ত হন, তাহার মধ্যে কিরীটেশ্বরী ‘ভবানীনাথ’ নামে লিখিত থাকে। বঙ্গবিনোদের পর ভগবানের পুত্র হরিনারায়ণ স্বীয় পিতার পদ ও সম্পত্তি প্রাপ্ত হইয়াছিলেন। হরিনারায়ণের পর তাহার পুত্র দর্পনারায়ণ উক্ত কাননগো পদ প্রাপ্ত হইয়া ঢাকায় অবস্থিতি করেন; সেই সময়ে ঢাকা বাঙ্গলার রাজধানী ছিল। দর্পনারায়ণের কার্যের শেষভাগে যৎকালে সম্রাট আরঙ্গজেবের পৌত্র আজিম ওশ্বান বাঙ্গলার মসনদে অধিষ্ঠিত থাকেন, সেই সময়ে মুর্শিদকুলী খাঁ আরঙ্গজেবের আদেশক্রমে বাঙ্গলার দেওয়ানী পদে নিযুক্ত হইয়া ঢাকায় আগমন করেন। নবাব আজিম ওশ্বানের সহিত দেওয়ান মুর্শিদকুলীর মনোমালিন্য উপস্থিত হওয়ায়, তিনি ঢাকা পরিত্যাগ করিয়া মুখসুসাবাদ বা মুখসুদাবাদে (পরে মুর্শিদাবাদ) আগমন করিলে, সঙ্গে সঙ্গে দেওয়ানী-সংক্রান্ত যাবতীয় কর্মচারী মুর্শিদাবাদে আসিতে বাধ্য হন; অগত্যা দর্পনারায়ণকেও আসিতে হয়। এই সময়ে জগৎশেঠদিগের আদিপুরুষ শেঠ মাণিকচাঁদও মুর্শিদাবাদে আসিয়াছিলেন। মুর্শিদাবাদের নবাব, জগৎশেঠ ও বঙ্গাধিকারিগণ মুর্শিদাবাদের প্রাচীন ও সম্মাননীয় বংশ এবং উক্ত তিন বংশেরই বাঙ্গলার শাসন ও রাজস্ব-সম্বন্ধে একাধিপত্য ছিল। দর্পনারায়ণ মুর্শিদাবাদে আসিয়া ডাহাপাড়ায় স্বীয় আবাস-ভবন নির্মাণ করেন। এই সময়ে বঙ্গাধিকারিগণ কিরীটেশ্বরীর নিকট অবস্থিতি করায়, তাহার গৌরব-বৃদ্ধির অনেক চেষ্টা করিতে থাকেন এবং মুর্শিদাবাদ বাঙ্গলার রাজধানী ছিল বলিয়া,
- ↑ সম্ভবতঃ যে সময়ে গুপ্ত সম্রাটগণ বাঢ় দেশে রাজত্ব করিতেন, সেই সময় হইতে কিরীটেশ্বরীর মাহাত্ম্য বিস্তৃত হয়। মুর্শিদাবাদের ইতিহাস দেখ।
- ↑ মঙ্গলবৈষ্ণব নবদ্বীপে মহাপ্রভুর সহিত সাক্ষাতের পর গদাধর প্রভুর নিকট শিষ্যত্ব গ্রহণ করিয়া বর্ধমান জেলার কাঁদরা নামক গ্রামের নিকট বাস করেন। তাহার পৌত্র বদনচাঁদঠাকুর প্রসিদ্ধ মনোহরসাহী সংকীর্তনের প্রবর্তক।