পাতা:মুর্শিদাবাদ কাহিনী.djvu/৮০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

একটি ক্ষুদ্র কাহিনী

 অতীত কালসাগরে কত উজ্জ্বল রত্ন লুক্কায়িত রহিয়াছে, কে তাহাদের গণনা করিবে? তাহাদিগের প্রভা দূরাগত নক্ষত্রালোকের ন্যায় এত ক্ষীণ যে, বিস্মৃতির ঘন্ধকার ভেদ করিয়া মুহূর্তের জন্য কাহারও নয়নপথে পতিত হয় কিনা সন্দেহ। যখন কোন ঐতিহাসিক সত্যানুসন্ধিৎসার রজু অবলম্বন করিয়া সেই অতলস্পর্শ সাগরগর্ভে নিমগ্ন হইতে থাকেন, তখন কেবল তাহারই চক্ষুর সমক্ষে সেই উজ্জ্বল রত্নরাজির কিরণলহরী ক্রীড়া করিতে থাকে। তিনি স্মৃতিস্তর হইতে সেই জ্যোতির্ময়ী রঙ্গমালার উদ্ধার করিয়া সাধারণকে উপহার প্রদান করেন। দুঃখের বিষয়, রত্নেদ্ধার সকল সময়ে সুচারুরূপে সম্পন্ন হয় না; কখন হয়তো কোন কোন ক্ষীণপ্রভ রঙ্গের উদ্ধার হয় এবং তৎসঙ্গে অনেক উজ্জ্বলতম রত্ন পরিত্যক্ত হইয়া থাকে। সে স্থলে আমরা তত দোষ দেখিতে পাই না। কিন্তু যেখানে সত্যানুসন্ধিৎসা-জুর একাংশ বিদ্বেষবুদ্ধির কৃষ্ণবর্ণে এবং অপরাংশ পক্ষপাতিত্বের স্বর্ণ বর্ণে রঞ্জিত করিয়া, উজ্জ্বল রত্নরাজিকে কৃষ্ণ ও ক্ষীণপ্রভ রত্ননিচয়কে উজ্জ্বলতর প্রতিপন্ন করিতে চেষ্টা করা হয়, তথায় ঐতিহাসিকগণ কর্তবব্যর অবমাননা করিয়া থাকেন। ভারতবর্ষের ইতিহাসে এরূপ দৃষ্টান্তের অভাব নাই। মুসলমান ঐতিহাসিকগণ যখন হিন্দুর ইতিহাস লিখিয়াছেন, তখন তাঁহারা অনেক স্থলে, তাহাদিগের গৌরবের লাঘব এবং কোনও কোনও স্থলে প্রকৃত ঘটনা গোপন করিতে লুটি করেন নাই। মুসলমানগণের ইতিহাস লিখিতে গিয়া ইংরেজ ঐতিহাসিকগণও উক্ত পথ অবলম্বন করিয়াছেন এবং স্থানে স্থানে বিদ্বেষবুদ্ধির পরিচয় দিয়া অনেক চরিত্রকে এরূপ অতিরঞ্জিত করিয়া তুলিয়াছেন যে, কোন মতে তাহাদের প্রবৃত্তির সমর্থন করা যাইতে পারে না।

 মুসলমানদিগের সহিত সংসৃষ্ট বলিয়া দুর্ভাগ্য হিন্দুগণও কোন কোন স্থলে ইংরেজ ঐতিহাসিকগণের লেখনীমুখে স্থান পান নাই এবং অনেক স্থলে কৃষ্ণবর্ণেও | চিত্রিত হইয়াছেন। যে মোহনলাল পলাশীর যুদ্ধে মীরমদনের পর অদম্য উৎসাহসহকারে ইংরেজসেনা মথিত করিবার উপক্রম করিয়াছিলেন, অর্মে প্রভৃতির ইতিহাসে তাহার সেই বীরত্বকাহিনীর কিছুমাত্র উল্লেখ নাই। পরবর্তী রূম ম্যালীস প্রভৃতিও অর্মের অনুসরণ করিয়াছেন। ভাগ্যে মুতাক্ষরীনকার সেই প্রভুভক্ত হিন্দুবীরের শৌর্ষময় বিবরণের বর্ণনা করিয়াছিলেন, তাই আমরা আজ তাহা লইয়া আত্মগৌরব করিতে পারিতেছি। তাই বঙ্গকবির অমৃতবর্ষিণী লেখনীতে চিত্রিত হইয়া মোহনলালের দেবদুর্লভ চিত্র আমাদের চক্ষের সমক্ষে নৃত্য করিয়া বেড়াইতেছে। এই রূপে বাঙ্গালীর গৌরবস্থল মহারাজ নন্দকুমার অনেক ঐতিহাসিকের নিকট কৃষ্ণবর্ণে চিত্রিত হইয়াছেন।[]

  1. Seir Mutacherin (English Translation), Vol. I, p. 768.