পাতা:মুর্শিদাবাদ কাহিনী.djvu/৮৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।
একটি ক্ষুদ্র কাহিনী
৭৭

বীরত্বে প্রীত হইয়া তাহাকে স্কন্ধে করিয়া লইয়া গিয়াছিল।[১] বালক ভাগীরথীতীরে যথারীতি সৎকার করিয়া পিতৃদেবের পবিত্র ভস্মরাশি গঙ্গার পবিত্র সলিলে ভাসাইয়া দিল। সেই পবিত্র ভন্মরাশিতে তাহার কয়েক বিন্দু পবিত্র অশ্রু পতিত হইয়া পবিত্রতার বৃদ্ধি করিল। পবিত্রসলিল ভগীরথী সেই পবিত্র অশ্রুসিক্ত পবিত্র ভস্মরাশি বক্ষস্থলে ধারণ করিয়া কুলুকুলুনাদে প্রবাহিত হইলেন। বালক পিতৃবিয়োগে কাতর হইয়া অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ সমুদ্রে ঝম্প প্রদান করিল। নবমবর্ষীয় রাজপুত বালকের এইরূপ অদ্ভুত সাহস ও পিতৃভক্তি জগতের ইতিহাসে বিরল। মুর্শিদাবাদের ইতিহাসে গিরিয়ার যুদ্ধ একটি প্রধান ঘটনা। রাজপুতবালক জালিমসিংহের অদ্ভুত কাহিনী সেই ঘটনাকে আরও স্মরণীয় করিয়া রাখিয়াছে।

 হিন্দুর ন্যায় পিতৃভক্তি জগতের কোন জাতি দেখাইতে পারে নাই। যাহার “পিতা স্বর্গ পিতা ধর্মঃ পিতা হি পরমংতপঃ, পিতরি প্রীতিমাপন্নে প্রীয়তে সর্বদেবতাঃ” এই মহাবাক্য কার্যতঃ পদে পদে প্রতিপালন করিয়া আসিয়াছে, তাহাদের নিকট পিতৃভক্তিতে জগতের সকল জাতিকে যে অবনত হইতে হইবে, তাহাতে সন্দেহ নাই। দুঃখের বিষয়, এই সমস্ত জ্বলন্ত পিতৃভক্তির কাহিনী আমরা অনেক সময়ে বর্ণনা করিতে বিস্মৃত হইয়াছি। পাশ্চাত্য জগতে এই সকল জ্বলন্ত, দৃষ্টান্ত কত সাহিত্যে কত কবিতায় স্থান পাইয়াছে, কিন্তু আমরা শত চেষ্টা করিলেও বিস্মৃতিস্তর হইতে কিছুতেই তাহাদের উদ্ধার করিতে পারি না। টিসিনসের যুদ্ধে হানিবল কর্তৃক আহত হইয়া কনিলিয়াস সিপিও অশ্বপৃষ্ঠ হইতে ভূতলে পতিত হইলে, তাহার সপ্তদশবর্ষীয় বালক সিপিও পিতার দেহ বহন করিয়া শিবিরে আনয়ন করিয়াছিল। এজহিলের যুদ্ধে প্রথম চার্লসের বৃদ্ধ সেনাপতি লিওসে পালিয়ামেন্ট সৈন্য-কর্তৃক আহত হইলে, তাহার দ্বাত্রিংশবর্ষবয়স্ক পুত্র লর্ড উইলোবী পিতাকে বহন করিয়া আনিয়াছিলেন। নীলনদের ভীষণ সমরে বালক ক্যাসাবিয়াঙ্ক৷ পিতার আদেশ প্রতিপালনের জন্য প্রজ্বলিত অগ্নিরাশির মধ্যে জীবন বিসর্জন দিয়াছিল। এই সমস্ত অদ্ভুত কাহিনী পাশ্চাত্য সাহিত্যে বণিত ও কবিতায় গীত হইয়া থাকে। কিন্তু আমাদের নবমবর্ষীয় বালক জালিমের কথা কেহ অবগত আছে কিনা জানি। কেবল যে-স্থানে তাহার অদ্ভুত বীরত্ব প্রকাশিত হইয়াছিল, গিরিয়া-প্রান্তরের সেই স্থানকে আজিও লোকে জালিমসিংহের মাঠ বলিয়া থাকে; কিন্তু জালিমসিংহের বিবরণ কেহই অবগত নহে। বিস্মৃতির ঘনীভূত অন্ধকার আমাদিগের উজ্জ্বল রত্নরাজিকে চিরদিনের জন্য আবৃত করিয়া রাখিয়াছে। জানি না, কোন কাকে তাহাদের উদ্ধার হইবে কিনা!

  1. জালিমকে যুদ্ধে লইয়া যাওয়ার কথা কেবল রিয়াজ গ্রন্থে উল্লিখিত হইয়াছে (Riyaz-us-salatin, p. 322.)