পাতা:মুর্শিদাবাদ কাহিনী.djvu/৯৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।
ভগবান্‌গোলা
৯১


 উপরে উল্লিখিত হইয়াছে যে, ভগবান্‌গোলার বাজার সমগ্র পরিজ্ঞাত জগতের সর্বশ্রেষ্ঠ বলিয়া কেহ কেহ নির্দেশ করিয়া থাকেন। বাস্তবিক, তৎকালে তথায় প্রতিনিয়ত লক্ষ লক্ষ মণ শস্য, ঘৃত, তৈল প্রভৃতি দ্রব্যের আমদানি-রপ্তানি হইত। উত্তরবঙ্গ, পূর্ববঙ্গ, রাঢ়, বিহার, সকল প্রদেশ হইতেই নানাবিধ দ্রব্যের আমদানি হইত এবং তৎসমুদায় সমগ্র ভারতে ও সমগ্র ইউরোপে বিস্তৃত হইয়া পড়িত। ভগবান্‌গোলার বাজার বঙ্গের বিভিন্ন স্থানের ধান্য, মুগ, কলাই, লঙ্কা, পলা প্রভৃতির নৌকা, তুলা, রেশম, নীল ও বস্ত্রাদির আমদানিতে সর্বদাই সমারোহময় থাকিত। শত শত বিপণীতে পরিপূর্ণ হইয়া বাণিজ্যলক্ষীর প্রিয়ক্রীড়াভূমিরূপে ভগবান্‌গোলা সকলের মনে আনন্দ ও উৎসাহের ধরা ঢালিয়া দিত। তথায় দেশীয়, বিদেশীয় নানাজাতীয় ক্রেতা, বিক্রেতা, দালাল, গোমস্তার কলরব প্রতিনিয়ত আকাশপথে উত্থিত হইত। ভগবান্‌গোলা সুবার খাস মহালের মধ্যে পরিগণিত ছিল। ইহার বাজার হইতে বার্ষিক ৩ লক্ষ টাকার কর আদায় হইত। কেবল ধান্য প্রভৃতি শস্য হইতেই বৎসরে ৩ লক্ষ টাকার শুল্ক সংগৃহীত হওয়ার উল্লেখ দেখা যায়।[১] সুতরাং ইহা হইতে বেশ অনুমান করা যায় যে, কিরূপ ভাবে ভগবান্‌গোলার বাজারে ক্রয়-বিক্রয়ের কার্য সম্পন্ন হইত। তৎকালে সমগ্র জগতে যে এরূপ বাজার ছিল না, ইহা স্পষ্টরূপে বলা যাইতে পারে। ভগবান্‌গোলার বর্তমান অবস্থান দেখিলে ঐ সমস্ত বিবরণ প্রবাদবাক্য বলিয়া বোধ হয়। মুর্শিদাবাদের গৌরবের সহিত অনেক দিন হইতে ইহার অধঃপতন ঘটিয়াছে। যে দিন হইতে মুর্শিদাবাদ-রাজলক্ষী চিরবিদায় গ্রহণ করিয়াছেন, সেই দিন হইতে মুর্শিদাবাদ অঞ্চলের প্রত্যেক স্থানেই অবনতির সহচর দুঃখদারিদ্রের কালিমাচ্ছায়া পড়িয়াছে এবং কোন কোন স্থান শ্মশান বা মরুভূমিতে পরিণত হইয়াছে।

 ভগবান্‌গোলার সহিত আর একটি বিশেষ ঐতিহাসিক ঘটনার সম্বন্ধ আছে। পলাশীর রণক্ষেত্রে পরাজিত হইয়া হতভাগ্য সিরাজ যখন প্রিয়তমা মহিষী। লুৎফউন্নেসার সহিত মুর্শিদাবাদ পরিত্যাগ করিরা পলায়ন করিবার চেষ্ট করেন, সেই সময়ে তিনি প্রথমে ভগবান্‌গোলায় আসিয়া উপস্থিত হন।[২] ভগবানগোলায় প্রায়ই নবাবের নৌকার বন্দোবস্ত থাকিত। তিনি নৌকারোহণে ভগবান্‌গোলা পরিত্যাগ করিয়া রাজমহলাভিমুখে গমন করিলে, মালদহের নিকট মীরজাফরের অনুচরবর্গ-কতৃক ধৃত হইয়া মুর্শিদাবাদে নীত হন। পরে তথায় তাহার মস্তক ভূমিলুষ্ঠিত হয়। যেদিন ভগবান্‌গোলা সিরাজকে চিরবিদায় দিয়াছিল, সেইদিন হইতে সিরাজের সঙ্গে সঙ্গে তাহারও সৌভাগ্য-রবি অস্তমিত হইতে আরম্ভ হয়।

 বর্তমান সময়ে ভগবান্‌গোলার অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয়। ইহার পূর্ব বাণিজ্য

  1. Holwell's Interesting Historical Events, Part 1, Chapter III, pp. 194 and 195.
  2. Seir Mutaqherin (English Translation), Vol. I, p. 771.