অতীতস্মৃতি যখন নবপরিণীতা বধূর ন্যায় ধীরে ধীরে মনোমন্দির অধিকার করিয়া বসে, তখন তাহার পাদস্পর্শে চারিদিকে ভাবের পারিজাত-কুসুম ফুটিয়া উঠে, জীবনের শুষ্ক মরুভূমি কোমলতার মধুর ধারায় অভিষিক্ত হইয়া যায়,হৃদয়-তন্ত্রীর তানগুলি মৃদু নিক্কণে ধ্বনিত হইতে থাকে। আমরা বর্তমানের নীরস ও বিশুদ্ধ রাজ্যের অধিবাসী; প্রতিদিন একই রূপের,—একই ভাবের ছবি আমাদের দৃষ্টিসমক্ষে ঘুরিয়া বেড়াইতেছে! আমরা সেই অবিকার, অবিশেষ দৃশ্যে ক্লান্ত হইয়া পড়িতেছি। তাই মধ্যে মধ্যে আমাদিগের ক্লিষ্ট প্রাণকে শান্ত করিবার জন্য অতীতস্মৃতি সোহাগিনী প্রণয়িনীর ন্যায় হৃদয়ে অমৃতধারা ঢালিয়া দেয়। যখন কোন পুরাতন স্থান দৃষ্টিপথের পথিক হয়, অথবা কোন পুরাণ-কাহিনী কর্ণকুহরে প্রবেশ করে, তখনই যেন কি এক প্রফুল্লতায় আমাদের চিত্ত পরিপূর্ণ হইয়া যায়। তখন আমরা বর্তমান ভুলিয়া অতীতের সঙ্গে মিশিয়া যাই এবং তাহার মাধুরীতে আপনাদিগকে সিক্ত করিয়া ফেলি। কোন কবি অতীতকে চিরসমাহিত করিতে উপদেশ দিয়া কেবল বর্তমানের উপর নির্ভর করিতে বলিয়াছেন। অবশ্য কার্যশীলমাত্রেই বর্তমান ব্যতীত আর কোন দিকে দৃষ্টিপাত করিবেন না সত্য, কিন্তু তাহা হইলেও, অতীতের মধুর স্মৃতি জীবনে যে কোমলতার ফুল ফুটাইয়া দেয়, তাহার পবিত্র সৌরভ হইতে একেবারে বঞ্চিত হইতে আমরা সকল সময়ে ইচ্ছা করি না।
পুরান স্থান ও পুরান কথা অতীতস্মৃতির উদ্বোধন করিয়া থাকে। সেইজন্য এমন কি, যখন কোনও ভগ্নস্তুপ বা বিধ্বস্তপ্রায় স্থান আমাদের দৃষ্টিপথে পতিত হয়, অথবা আমরা কিয়ৎকালের জন্য কোন অসংলগ্ন প্রাচীন উপকথায় মনোনিবেশ করি, তখন আমরা যেন তাহাদেরও মধ্যে অতীতের মনোমমাহিনী ছবি দেখিতে পাই। সে ছবি অস্পষ্ট হইলেও মধুরতাময়ী। প্রায় সার্ধশত বৎসর অতীত হইল, মোতিঝিলের গৌরবকাহিনী মুর্শিদাবাদের ইতিহাসে স্থান পাইয়াছে। তাহার তীরস্থিত প্রাসাদ মুসলমান রাজত্বের শেষ ভাগে ও ইংরেজ-রাজত্বের প্রারম্ভে অনেক অভিনয়ের রঙ্গভূমিরূপে পরিগণিত হইয়াছিল। অনেক দিন হইল, সে প্রাসাদ ধূলিরাশিতে পরিণত হইয়াছে; কেবল তাহার ভিত্তিভূমি তৃণাচ্ছাদিত হইয়া অতীতের কথা স্মৃতিপটে বিকাশ করিয়া দিতেছে। মোতিঝিলের অবস্থা পূর্বের ন্যায় তেমন। সৌষ্ঠবশালিনী না হইলেও, ইহার বর্তমান রমণীয় দৃশ্যে মনপ্রাণ মুগ্ধ হইয়া উঠে। এক কালে যাহাতে কত ঘটনা সংঘটিত হইয়াছিল, এক্ষণে তাহার সুন্দর দৃশ্যটিমাত্র আমাদিগকে আকর্ষণ করিয়া থাকে।
স্পেন্সার বলেন, পূর্বে যে-স্থানে কোন বিশেষ প্রয়োজন সংসাধিত হইত, এক্ষণে কেবল তাহা সৌন্দর্যশক্তিরই পরিচায়ক ব্যতীত আর কিছুই নহে; বিধ্বস্তপ্রায় দুর্গাদি ইহার প্রকৃত দৃষ্টান্ত। যাহা পূর্বে বাসনিকেতন ও আত্মরক্ষার আশ্রয় বলিয়া