গিরি। “তা কি জানি, জিজ্ঞাসা করিলে বলিবে না। সে কাঁদিয়াই থাকে। আমি এখন গীত গায়িলে পাছে রাগ করে?”
রত্ন। “তা করুক, তুমি এমন সাধে বঞ্চিত হবে কেন? চন্দ্রসূর্য্যের পথ বন্ধ হবে তবু তোমার গলাবন্ধ হবে না। তুমি এখানে না পার, পুকুর ধারে বসিয়া গাও।”
গি। “বেশ বলেছ সই। তুমি শুন।”
এই বলিয়া গিরিজায়া পাটনীর গৃহের অনতিদূরে যে এক সোপানবিশিষ্ট পুষ্করিণী ছিল, তথায় গিয়া সোপানোপরি উপবেশন করিল। শারদীয়া পূর্ণিমার প্রদীপ্ত কৌমুদীতে পুষ্করিণীর স্বচ্ছ নীলাম্বু অধিকতর নীলোজ্জ্বল হইয়া প্রভাসিত হইতেছিল। তদুপরি শ্বেত রক্ত কুমুদমালা অর্দ্ধ প্রস্ফুটিত হইয়া নীল জলে প্রতিবিম্বিত হইয়াছিল; চারিদিকে বৃক্ষমালা নিঃশব্দে পরস্পরাশ্লিষ্ট হইয়া আকাশের সীমা নির্দ্দেশ করিতেছিল; ক্কচিৎ দুই একটি দীর্ঘশাখা উর্দ্ধোত্থিত হইয়া আকাশ পটে চিত্রিত হইয়া রহিয়াছিল। তলস্থ অন্ধকারপুঞ্জ মধ্য হইতে নবস্ফুট কুসুম সৌরভ আসিতেছিল। গিরিজায়া সোপানোপরি উপবেশন করিল। সে জানিত, যে তথা হইতে সঙ্গীত ধ্বনি মৃণালিনীর কর্ণগোচর হইবার সম্ভাবনা—কিন্তু ইহাও তাহার নিতান্ত অসাধ নহে—বরং তাহাই কতক উদ্দেশ্য। আর উদ্দেশ্য নিজ পরযন্ত্রণাকাতর বিকৃতচিত্তের ভাবব্যক্তি। গিরিজায়া ভিখারিণী বেশে কবি; স্বয়ং কখন কবিতা রচনা করুক বা না করুক, কবির স্বভাবসিদ্ধ চিত্তচাঞ্চল্যপরতা প্রাপ্ত হইয়াছিল। সুতরাং কবি। কে না জানে যে কবির মনঃসরোবরে বায়ু বহিলে বীচি বিক্ষিপ্ত হয়?
গিরিজায়। প্রথমে ধীরে ধীরে, মৃদু মৃদু, গীত আরম্ভ করিল—যেন নবশিক্ষিত বিহঙ্গিনী প্রথমোদ্যমে স্পষ্ট গান