পাতা:মেজদিদি - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/৩৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

কেন? এত লুকোচুরি কথাবার্তাই বা তোমাদের কি, আর এত আহলাদ দেওয়াই বা কি জন্যে? কতদিনের পুঞ্জীভূত আবদ্ধ বিদ্বেষরাশি যে এই একটু পথ পাইয়া বাহির হইয়া আসিল, তাহা যিনি সব দেখেন, তিনি দেখিতে পাইলেন।

 মুহুর্তকালের জন্য হেমাঙ্গিনী হতজ্ঞানের মত স্তম্ভিত হইয়া রহিলেন। এমন নিষ্ঠুর আঘাত, এত বড় নির্লজ্জ অপমান, মানুষ মানুষকে যে করিতে পারে, ইহা যেন তাঁহার মাথায় প্রবেশ করিল না। কিন্তু ঐ মুহুর্তকালের জন্য। পরীক্ষণেই তিনি মর্মান্তিক আহত সিংহীর মত দুই চোখে আগুন জ্বালিয়া বাহির হইয়া আসিলেন। ভাশুরকে সুমুখে দেখিয়া মাথার কাপড় আর একটু টানিয়া দিলেন, কিন্তু রাগ সামলাইতে পারিলেন না। বড়-জাকে সম্বোধন করিয়া মৃদু অথচ কঠোরস্বরে বলিলেন, তুমি এতবড় চামার যে, তোমার সঙ্গে কথা কইতেও আমার ঘৃণা বোধ হয়। তুমি এতবড় বেহায়া মেয়েমানুষ যে, ঐ ছোঁড়াটাকে ভাই বলেও পরিচয় দিচ্ছ। মানুষ জানোয়ার পুষিলে তাকেও পেট ভরে খেতে দেয়, কিন্তু ঐ হতভাগাটাকে দিয়ে যত-রকমের ছোট কাজ করিয়ে নিয়েও তোমরা আজ পর্যন্ত একদিন পেট ভরে খেতে দাও না। আমি না থাকলে এতদিনে ও না খেতে পেয়েই মরে যেত। ও পেটের জ্বালায় ছুটে আসে আমার কাছে, সোহাগ-আহ্লাদ করতে আসে না।

 বড়-জা বলিলেন, আমরা খেতে দিই নে, শুধু খাটিয়ে নিই, আর তুমি ওকে খেতে দিয়ে বঁচিয়ে রেখেচ?

 হেমাঙ্গিনী জবাব দিলেন, ঠিক তাই। আজ পর্য্যন্ত কখনও ওকে দু’বেলা তোমরা খেতে দাওনি।—কেবল মারধোর করেচ, আর যত পেরেচ খাটিয়ে নিয়েচ। তোমার ভয়ে হাজার দিন ওকে আসতে বারণ করেচি, কিন্তু খিদে বরদাস্ত করতে পারে না, আর আমার কাছে পেট ভরে দুটো খেতে পায় বলেই ছুটে ছুটে আসে-চুরিডাকাতির পরামর্শ নিতে আসে না। কিন্তু তোমরা এতবড় হিংসুক যে, তাও চোখে দেখতে পার না।

৩৫