পাতা:মৈমনসিংহ গীতিকা (প্রথম খণ্ড) - দীনেশচন্দ্র সেন.pdf/১৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৷৷৹
মৈমনসিংহ-গীতিকা

মাল্য দেওয়ার গান্ধর্ব্বরীতি এ সমাজ হইতে অনেক দিন হইল অন্তর্হিত হইয়াছে[১]। এই পল্লীগাথায় রমণীরা অনেকবার কুলধর্ম্ম বিসর্জন দিয়াছেন, কিন্তু কখনই নারীধর্ম্ম ত্যাগ করেন নাই। বরঞ্চ নারীধর্ম্মের যে জীবন্ত মূর্ত্তিগুলি এই সকল গাথায় পাওয়া যাইতেছে—তাহারা পাতিব্রত্যে, বুদ্ধিব তীক্ষতায়, বিপদে, ধৈর্য্যে উপায়-উদ্ভাবনায় এবং একনিষ্ঠায় অতুল্য।

৩। এই গীতিসাহিত্যে নারীচিত্র

 সুতরাং হিন্দু সমাজের এই অভিনব চিত্রগুলিতে যে জীবন ও আনন্দ পাওয়া যাইতেছে, তাহা শ্রাবণের নদীপ্রবাহের ন্যায় শক্তি ও স্ফূর্ত্তিতে ভরপুর। এই অবাধ শক্তি ও আনন্দের বন্যায় ঐরাবতের ন্যায় দুর্জয় বাধাবিঘ্ন ভাসিয়া গিয়াছে। আমরা প্রাচীন সমাজের আবর্জনাময় পঙ্কিল ডোবা দেখিতে অভ্যস্ত হইয়াছি, এই গিরিনদীর স্ফূর্ত্তি দেখিতে দেখিতে হয়ত আমাদের ভিতরকার জীর্ণ সংস্কারগুলি ক্ষণকালের জন্য মন হইতে খসিয়া পড়িতে পারে। এই পল্লীগাথার আবিষ্কার আমার চক্ষে খুব বড় রকমের একটা জাতীয় ঘটনা। ইহা আমাদের অন্ধ চক্ষে দৃষ্টিদান করিতে পারে। এই পালাগুলিতে দেখা যায়, আমরা যে সতীত্বের বড়াই করিয়া থাকি, তাহার জন্ম আইনকানুনে এবং আচার্য্যের মস্তিষ্কে নহে, তাহার জন্ম প্রেমে, তাহা নিজের বলে বলীয়ান্। বাহিরের শক্তি যে পাতিব্রত্যকে রক্ষা করে, তাহার শক্তি দুর্ব্বলতার ছদ্মবেশ মাত্র, কিন্তু প্রেম যাহাঁকে জন্ম দিয়াছে, প্রেম যাহাঁকে রক্ষা করিতেছে, তাহা ঋষি বচনের প্রতীক্ষা করে না। তাহা হিন্দুসমাজের নিজস্ব নহে, তাহা সমস্ত মানবজাতির আরাধনার ধন। সমাজ তাহাকে রক্ষা করে না, সমাজকেই তাহা রক্ষা করে।

 এই যে মনের অগাধ অনুরাগ, পল্লীগাথাগুলি পড়িলে দেখা যায় তাহার কি দুর্জয় শক্তি! হাতীর সাহায্যে মর্কট আসিলে, তাহা দেখিলে হাসি পায়। এই অটল নিষ্ঠাকে যে ব্যক্তি একাদশীর উপবাস ও প্রোষিতভর্ত্তৃকার আইন জারি করিয়া বাঁচাইয়া রাখিতে চায়, সে সোনার উপর গিল্টি করে এবং হীরার উপর রং ফলাইয়া তাহা উজ্‌জ্বল করিতে চায়। মহুয়ার প্রেম কি নির্ভীক, কি আনন্দপূর্ণ! শ্রাবণের শত ধারার ন্যায় দুঃখ আসিতেছে, কিন্তু এই প্রেমের মুক্তাহার কণ্ঠে পরিয়া মহুয়া চিরবিজয়ী, মৃত্যুকে বরণ করিয়া মৃত্যুঞ্জয়ী হইয়াছে। তাহার পার্শ্বে পালঙ্কসখীর ত্যাগ কিরূপ স্বল্প কথায় ব্যক্ত ও অনাড়ম্বর। উহা বাক্যদ্বারা পল্লবিত না হইয়াও শ্রেষ্ঠতম আদর্শে পৌঁছিয়াছে। মলুয়ার পূর্ব্বরাগ, বাসরঘরে স্বামীর সহিত আলাপ, কাজীর ধৃষ্ট প্রস্তাবের প্রত্যুত্তর—এই সমস্ত কি অপূর্ব্ব! এই অতুলনীয় চিত্র জীর্ণ গৃহে, অনশনে, স্বামীবিরহে, দেওয়ানের হাবলিতে, সর্পদষ্ট স্বামীর পাশ্বে এবং

  1. ভেলুয়া সুন্দরী (দ্বিতীয় খণ্ডে মুদ্রিত), ও দেওয়ান ভাবনা দেখ।