পাতা:মৈমনসিংহ গীতিকা (প্রথম খণ্ড) - দীনেশচন্দ্র সেন.pdf/১৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৷৷৵৹
মৈমনসিংহ-গীতিকা

ব্রহ্মচর্য্য কি, দেওয়ান সাহেবের হাব্‌লিতে তাহা মলুয়া দেখাইয়াছে। মহুয়া ও সখিনা রমণীর রণরঙ্গিণী মূর্ত্তি। এই দেশের মেয়েরা ফুলের কুঁড়ির মত কিরূপে অনুরাগে ঝরিয়া পড়ে, লীলা ও মদিনার সেই অনুরাগ মূর্ত্ত। দুঃখ আত্মাকে কিরূপ সহিষ্ণুতা ও ভক্তির বর্ম্মে আবৃত করিয়া রাখে চন্দ্রা তাহা নীরবে দেখাইতেছেন।

৪। বঙ্গসাহিত্যে সংস্কৃতযুগের পূর্ব্বাধ্যায়

 শুধু বঙ্গরমণীর কথা নহে, এই সকল গাথায় আমাদের প্রাচীন ইতিহাসের অনেক দিক্‌ স্পষ্ট হইয়াছে। ময়নামতীর গান, গোরক্ষবিজয়, শূন্যপুরাণ, সূর্য্যের ছড়া, চণ্ডী ও মনসা দেবীর আদি গান, ব্রতকথা, রূপকথা, ডাক ও খনার বচন— প্রাচীন সাহিত্যের এই বিবিধ রচনার সঙ্গে এই গীতিগুলির এক পঙ্‌ক্তিতে স্থান হইবে। পূর্বোক্ত সাহিত্যের সঙ্গে ইহারা এক ছন্দে এক তানে বাঁধা,—তাহাদের ভাষাগত রচনা ও ভাবগত ঐক্য সকলের চক্ষেই পড়িবে। সেই চিরপরিচিত অমার্জিত বঙ্গের পল্লীকণ্ঠা এবং ‘কোন্ কাম করিল’[১] প্রভৃতি কথার ভঙ্গী, এই সমস্ত সাহিত্য জুড়িয়া আছে।

 ব্রাহ্মণ্যের পুনরুত্থানে, গিরিনদীর তেজে সংস্কৃতের প্রবাহ আসিয়া আমাদের ভাব ও ভাষা ভাসাইয়া লইয়া গিয়াছে। পূর্ব্বোক্ত পুঁথিগুলির গ্রাম্য ভাষা ও ভাবের সঙ্গে পরবর্ত্তী সাহিত্যের বিভিন্নতা অতি স্পষ্ট। মনসাদেবীর ভাসান ও চণ্ডীমঙ্গল প্রভৃতি প্রাচীন যুগের কয়েকখানি পুঁথির উপর পণ্ডিতদের কৃপাদৃষ্টি পড়িল। তাঁহারা তাহাদের ভাব ও ভাষার উপর তুলি চালাইয়া তাহাদিগকে সংস্কৃতযুগের সাহিত্যের অঙ্গীয় করিয়া লইলেন, কিন্তু জোড়া অনেক সময় বেখাপ্পা হইয়া রহিল। চণ্ডীকাব্যের মুকুন্দরাম ফুল্লরার বারমাসীতে গ্রাম্য ভাব ও ভাষার ছন্দটি ঠিক রাখিয়াছেন, কিন্তু সেই সকল অকৃত্রিম সরল ভাষার উক্তির মধ্যে হঠাৎ ‘জানু ভানু কৃশানু শীতের পরিত্রাণ’ এইরূপ দু-একটি সংস্কৃতাত্মক পদ নির্ঝরগতির মধ্যে শৈলখণ্ডের মত পথ রোধ করিয়া দাঁড়াইয়া আছে। মুরারি শীলের সহিত কালকেতুর কথাবার্ত্তা, ফুল্লরার সঙ্গে লহনার ঝগড়া, বণিক্‌সভায় মালাচলনের উপলক্ষে বাগ্‌বিতণ্ডা প্রভৃতি অংশ খাঁটি প্রাচীন ছড়া, কিন্তু ভগবতীর রূপবর্ণ না, খুল্লনার ছাগলরক্ষার সময়ে বনে বসন্তের আবির্ভাব, সুশীলার বারমাসী প্রভৃতি রচনায়, বাঙ্গালা ভাষার উপর সংস্কৃত একটা

  1. পূর্ব্বোক্ত পুস্তকগুলি পূর্ব্ববঙ্গ, উত্তরবঙ্গ ও অপরাপর প্রদেশ হইতে পাওয়া যাইতেছে। লেখার ভঙ্গী তথাপি সর্ব্বত্রই একভাবের। এক ঘটনার পর অন্য ঘটনা বর্ণনা করিতে গেলে এই বিভিন্ন দেশের কবিরা “কোন্ কাম করিল” এই কথা দ্বারা শেষের ঘটনা বর্ণনা করিয়া থাকেন—ইঁহাদের রচনারীতি একরূপ।