পাতা:মৈমনসিংহ গীতিকা (প্রথম খণ্ড) - দীনেশচন্দ্র সেন.pdf/১৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
ভূমিকা
৷৷৶৹

মুখোশ পরাইয়া দিয়াছে। বঙ্গপল্লীর দয়েলটি ময়ূর সাজিয়া বাহির হইয়াছেন। এই সকল মন্তব্য মনসামঙ্গলের প্রতি ও ধর্ম্মমঙ্গলের প্রতিও তুল্যরূপেই প্রযোজ্য।

 এই ছড়াগুলি ছিল সংস্কৃত প্রভাবের পূর্ব্ববর্ত্তী যুগের। তখন সিন্ধাবাদের স্কন্ধে বৃদ্ধের মত বাঙ্গালা ভাষার উপর সংস্কৃতের আদর্শ আসিয়া এরূপ দুরন্তভাবে চাপিয়া বসে নাই। এই সকল কাব্যের নায়ক-নায়িকা—বেনে, সদ্‌গোপ, বৈশ্য, ব্যাধ এমন কি ডোমজাতীয়। ইহাতে ব্রাহ্মণের টোলে বেনে ধর্ম্মশাস্ত্র পড়িতেছে, গন্ধবেনে সত্য বলার অপরাধে ব্রাহ্মণপণ্ডিতকে গলাধাক্ক। মারিয়া সদর দরজার বাহির করিয়া দিতেছে। ব্রাহ্মণ্যগৌরবের অদ্বিতীয় ব্যঞ্জনা-স্বরূপ যজন-যাজন ও যজ্ঞের সময়ই যজ্ঞোপবীতের প্রয়োজন হইত। পৈতাটা তখনও ব্রাহ্মণের অপরিহার্য অঙ্গীয় হইয়া দাঁড়ায় নাই। কোথায়ও যাওয়ার সময়ে উত্তরীয় ও উপনীত উভয়ই পোষাকী দ্রব্যের ন্যায় খুঁজিয়া বাহির করিয়া গলায় পরিতে হইত।

 যে সকল গান ও ছড়া, দেবমণ্ডপে বহু শতাব্দী পূর্ব হইতে গীত হইয়া পূজার পক্ষে অপরিহার্য্য হইয়া উঠিয়াছিল,, পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতাব্দীতে নবমন্ত্রে দীক্ষিত ব্রাহ্মণপণ্ডিতগণ তাহা পরিহার করিতে পারিলেন না। তাঁহারা ছড়া গ্রহণ করিলেন, কিন্তু কাস্তে ভাঙ্গিয়া করতাল গড়িয়া লইলেন। ভুবনেশ্বরের মন্দির যদি একালের কোন স্থপতি সংস্কার করেন তবে নূতন-পুরাতনে যে বিষম সংযোগ হয়, তাহা চক্ষে ঠেকিবেই। এই রিফুকর্ম্মটা কখনই বেমালুম হয় না। মুকুন্দরাম, বিজয়গুপ্ত, ঘনরাম ও রামেশ্বর প্রভৃতি কবিগণ প্রাচীন পালাগুলি লইয়া যে নব্যলীলা খেলিয়াছেন, তাহাতে দুই যুগের ভাব ও ভাষার আদর্শ পৃথক্ হইয়া আছে, তাহা অতি সহজেই ধরা পড়িয়া যায়।

 আমরা দেখিতেছি, বাঙ্গালা সাহিত্যের যাহা শ্রেষ্ঠ সম্পদ্, তাহাদ্বারা সংস্কৃতপূর্ব যুগই তাহাকে মণ্ডিত করিয়াছিল। সেই যুগেই গোরক্ষনাথের অমরালেখ্য অঙ্কিত হয়, সেই যুগেই বেহুলা ও মালঞ্চমালার ন্যায় রমণীতিলকেরা বঙ্গসাহিত্যের কিরীট উজ্‌জ্বল করিয়াছিলেন। সেই সময়েই কালু ডোম, কালকেতু ও চাঁদ সদাগরের ন্যায় মৌলিক, একব্রত, অটল চরিত্রগুলি এই সাহিত্যের বিভূষণ হয়। পরবর্ত্তী কবিগণ পূর্ব্বের সেই কার্যগুলিকে শোধন করিয়াছেন, ভাষা উজ্‌জ্বল করিয়াছেন, ভাব ও ছন্দ কবিত্বে ভূষিত করিয়াছেন, কিন্তু প্রায় সর্ব্বত্রই পূর্ব্বযুগের মহিমান্বিত চরিত্রগুলিকে স্বল্পাধিক পরিমাণে গৌরবহীন ও খর্ব্ব করিয়া ফেলিয়াছেন। কেতকাদাস-ক্ষেমানদের হাতে চাঁদ সওদাগরের ন্যায় বীর গৌরব হারাইয়া কতকটা হাস্যাস্পদ হইয়া উঠিয়াছেন।

 যে কালে সেই সকল প্রাচীন পালা রচিত হইয়াছিল (১০ম হইতে ১২শ শতাব্দীর মধ্যে) তখন হিন্দুজাতি সতেজ ও সবল ছিল। তখন সমাজে গুণের আদর ছিল, গুণীর অভাব ছিল না। বাঙ্গালী জাতির আশয় ও আকাঙ্‌ক্ষা উচচ ছিল, বাঙ্গালী বণিক্ সমুদ্রকে রত্নাকর