পাতা:মৈমনসিংহ গীতিকা (প্রথম খণ্ড) - দীনেশচন্দ্র সেন.pdf/২০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৸৵৹
মৈমনসিংহ-গীতিকা

সীতা রামের মুখে সন্দেহের কথা শুনিয়া মৃদু কান্নার গুঞ্জরণের সহিত বলিয়াছিলেন, নিতান্ত শিশুকালেও তিনি পুরুষ ছেলেদের সাথে খেলা করেন নাই। এই ছোঁয়াচে রোগ সমস্ত জাতিকে পাইয়া বসিয়াছিল।

 পাঠক মৈমনসিংহ-গীতিকায় এক নূতন রাজ্যে প্রবেশ করিবেন। প্রেম জিনিসটা কষ্টকে বরণ করিয়াই আবির্ভূত হইয়া থাকে, কিন্তু নিজের আনন্দই উহার পরম তৃপ্তি, ইহা শক্তিপ্রয়োগে পাওয়া যায় না। এই দুর্লভ জিনিসটা হিন্দুর ঘরে কি করিয়া প্রকাশ পাইয়াছিল, গীতিকাগুলি পড়িয়া পাঠক নিজে তাহার পরিচয় পাইবেন। এই মৈমনসিংহ হইতেই আমরা মালঞ্চমালা, শঙ্খমালা, কাঞ্চনমালা এবং পুষ্পমালার কথা পাইয়াছি। এই কথাচতুষ্টয় গীতিকথা নামে অভিহিত। শ্রীযুক্ত দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার মহাশয় তাঁহার সঙ্কলিত অপূর্ব্ব ‘ঠাকুরদাদার ঝুলি’ পুস্তকে এই গীতিকথাগুলি সন্নিবিষ্ট করিয়াছেন। সেই গীতিকথার পার্শ্বে এই খণ্ডে প্রকাশিত ‘কাজলরেখা’ এক পঙ্‌ক্তিতে স্থান পাইবার যোগ্য, এটিও একটি গীতিকথা। গীতিকথাগুলি শুধুই উপাখ্যান। এই সংখ্যায় প্রকাশিত কাজলরেখা ছাড়া অন্য সমস্ত গীতিকাই ঐতিহাসিক ঘটনামূলক। কিন্তু আশ্চর্য্যের বিষয় এই যে, উপাখ্যান ও ঐতিহাসিক ঘটনা উভয়েরই আদর্শ টা ঠিক একরূপ। উপাখ্যানগুলিতে অনেক আজগুবি কথা আছে, ঐতিহাসিক গাথায় একটিও আজগুবি কথা নাই, প্রভেদ এই পর্যন্ত। কিন্তু উপাখ্যানের কাজলরেখা ও মালঞ্চমালা এক দিকে এবং ঐতিহাসিক মলুয়া ও মদিনা অপর দিকে। প্রেমের রাজ্যে ইহারা সহোদরা। শ্মশানের চিতায় যে সুন্দরী নারী হ্যালিডে সাহেবের সম্মুখে একটা দীপশিখাতে নিজের আঙ্গুলটি ভস্মীভূত করিয়া স্থির অটলমূর্ত্তিতে বলিয়াছিল, “সাহেব, বল ত দেহটা আরও পোড়াইয়া দেখাই। তুমি না বলিতেছ, আমি আগুনের যন্ত্রণা বুঝি না, এইজন্য না বুঝিয়া সহমরণ যাইতেছি।” সেই সুন্দরী রমণী মলুয়ায় কি কোন প্রভেদ আছে? এই গীতিকাগুলির নারীচরিত্রসমূহ প্রেমের দুর্জয় শক্তি, আত্মমর্য্যাদার অলঙ্ঘ্য পবিত্রতা ও অত্যাচারীর হীন পরাজয় জীবন্তভাবে দেখাইতেছে। নারীপ্রকৃতি মন্ত্র মুখস্থ করিয়া বড় হয় নাই,—চিরকাল প্রেমে বড় হইয়াছে। জননীরূপে তিনি জগতের বরেণ্যা, স্ত্রীরূপে তিনি জগতের প্রাণ। প্রকৃতি যেখানে সেই প্রাণ দান করেন, সেখানে সে প্রাণ অপূর্ব্ব হইয়া দাঁড়ায়। সমাজের পুরোহিতের কি সাধ্য যে সেই অপূর্ব্ব প্রেরণার সৃষ্টি করিতে পারে? এইজন্য এই গীতিকাগুলির সর্ব্বত্র দেখা যায় পুরুষ ও নারী নিজেরা বিবাহের পূর্ব্বে পরস্পরকে আত্মদান করিয়াছেন, তারপর বিবাহ হইয়াছে। দ্বিতীয় খণ্ডে ‘ভেলুয়া সুন্দরী’ গাথা প্রকাশিত হইলে পাঠক তাহাতে দেখিতে পাইবেন পিতামাতার মতের বিরুদ্ধে দম্পতী নিজেরাই মাল্যবিনিময় করিয়াছেন। ফিরোজ খাঁর পালায় সখিনা নিজে দেওয়ানকে স্বামিরূপে বরণ করিয়া পিতা ওমর খাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করিতেছেন।