পাতা:মৈমনসিংহ গীতিকা (প্রথম খণ্ড) - দীনেশচন্দ্র সেন.pdf/২১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
ভূমিকা
৸৶৹

এই খণ্ডেই সোনাই নিজে মাতা ও মাতুলের মত না লইয়াই মাধবকে বররূপে বরণ করিয়াছেন। বিবাহের অনেক পূর্ব্বে কমলা প্রদীপ কুমারকে নিজের হৃদয় দিয়া ফেলিতেছেন এবং মলুয়াও সেই ভাবে চাঁদ বিনোদকে দেখিয়া মুগ্ধা হইয়া পড়িতেছেন,—এমন কি চন্দ্রার মত ধর্ম্মশীলা সংযমশীলা তপস্বিনী নারীও বিবাহ-প্রস্তাবনার বহুপূর্ব্বে জয়চন্দ্রকে স্বামিরূপে হৃদরে গ্রহণ করিতেছেন। এই ভাবের ছড়ায় এক সময়ে বঙ্গদেশ প্লাবিত ছিল বলিয়া মনে হয়। পৌরোহিত্যের প্রভাবে নায়িকাদের সেই স্বাধীন মনোনয়ন-প্রথা একেবারে অন্তর্হিত হইয়াছে। এমন কি নব ব্রাহ্মণ্য ধর্ম্মের আদর্শানুসারে এই প্রথার সৌন্দর্য্য আবিষ্কার করা ত দূরের কথা, ইহা কুৎসা ও লজ্‌জাজনক ব্যাপারে পরিণত হইয়াছে। খুল্লনা ও ধনপতির বিবাহ-পূর্ব্ব প্রেমচিত্রটি মুকুন্দরাম যেন দাঁতে জিভ কাটিয়া কোনরূপে সামলাইয়া লইয়াছেন। প্রাচীন ছড়াটা তিনি পরিবর্তন করিয়াও তাহাতে যথেষ্ট আভাস রাখিয়া গিয়াছেন, যাহাতে বুঝা যায় যে পিতামাতা ঠিক করিয়া দেওয়ার পূর্বেই বরকন্যার নিজেদের মধ্যে একটা বোঝাপড়া করার রীতি পূর্ব্বে প্রচলিত ছিল। স্বয়ং চৈতন্যপ্রভু বল্লভাচার্য্যের কন্যা লক্ষ্মীকে দেখিয়া ভুলিয়াছিলেন এবং শুভদৃষ্টির পূর্ব্বেও দম্পতীর মধ্যে চারি চক্রের একটা প্রেমদৃষ্টির বিনিময় হইয়াছিল,—তাহার আভাস চৈতন্যভাগবতে আছে। এই পূর্ব্বরাগটাকে সমাজের পাণ্ডাগণ শেষে একেবারে গলা টিপিয়া মারিয়া ফেলিয়া অষ্টম বৎসর বয়সে গৌরীদানের প্রথা পুথি হাতে করিয়া জোর গলায় ঘোষণা করিয়াছিলেন। কিন্তু অভূতপূর্ব্বভাবে মৈমনসিংহ হইতে আমরা সমাজের পূর্ব্বাধ্যায়ের কতকগুলি আলেখ্য পাইতেছি। নব ব্রাহ্মণ্য ধর্ম্ম সেই প্রদেশে জয়ডঙ্কা বাজাইতে পারে নাই, এইজন্য আদিম আদর্শের গৌরবশ্রী সেখানে অনেক দিন পর্য্যন্ত অক্ষুণ্ণ ছিল।

 এই সকল গীতিকার নায়ক-নায়িকাদের কাহারও বাল্যকালে পরিণয় হয় নাই। চৌদ্দ, পনের এমন কি সতের বৎসর পর্যন্ত মেয়েদিগকে অবিবাহিতা দেখিতে পাই। মুকুন্দরাম পুরাতন চণ্ডীর পালার রিফুকর্ম্ম করিতে গিয়া বেশ একটু বিপদে পড়িয়াছিলেন। প্রাচীন ছড়ায় ছিল যে, খুল্লনা যৌবনে পদার্পণ করিয়া ধনপতি সওদাগরের প্রেমে আকৃষ্ট হন। কি ভয়ানক কথা! নূতন সমাজের পাণ্ডা ব্রাহ্মণ-কবি একজন পুরোহিতকে উপস্থিত করাইয়া খুল্লনার পিতাকে খুব ধমকাইয়া দিয়াছেন। সাত বৎসরের মেয়ের বিবাহের মহাফল এবং তারপর আট বৎসর, উর্দ্ধে নয় বৎসর,—ইহার পরেও বিবাহ না হইলে যে পিতামাতার অদৃষ্টে ঘোর নরক, শাস্ত্রের বচনসহ পুরোহিতের মুখে কবিকঙ্কণ লক্ষ্মীপতিকে তাহা বেশ ভাল করিয়া বুঝাইতেছেন। এদিকে বেহুলাও যৌবনে পদার্পণ করিয়াই লক্ষ্মীন্দরকে বিবাহ করিতেছেন, এমন কি নিজে উপযাচক হইয়া এই বিবাহে ঔৎসুক্য প্রকাশ করিতেছেন;— বিবাহবাসরে লক্ষ্মীন্দর তাঁহার আলিঙ্গনলিপ্সু হইতেছেন;—এই সকল কথা সংস্কৃতযুগের