পাতা:মৈমনসিংহ গীতিকা (প্রথম খণ্ড) - দীনেশচন্দ্র সেন.pdf/২২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১৲
মৈমনসিংহ-গীতিকা

কবিগণ প্রাচীন ছড়া লইয়া নাড়াচাড়া করার সময়ে যথাসাধ্য আড়ালে ফেলাইতে চেষ্টা করিয়াছিলেন।

 সুতরাং দেখা যাইতেছে, মৈমনসিংহ-গীতিকায় যে সকল কথা খুব স্পষ্টভাবে লিখিত হইয়াছে, বঙ্গদেশের অন্যত্রও সামাজিক আদর্শ কতকটা সেইরূপ ছিল এবং তাহার কিছু কিছু আভাস প্রাচীন সাহিত্যে পাওয়া যায়। সেনরাজগণের পূর্ব্বে হিন্দুসমাজের যে আদর্শ ছিল, তাহা আমরা এমন পরিষ্কারভাবে এই গাথাগুলিতে পাইতেছি যে, তাহাতে দ্বিধা করিবার কোন অবকাশ নাই।

 একমাত্র মহুয়া এই গাথাগাহিত্যে অতীব অভিনব সামগ্রী—ইহা ঘরেরও নহে, বাহিরেরও নহে। এই গীতিকায় জাতিবিচার, কুলশীল, পদমর্যাদা সমস্তই প্রেমরত্নাকরের অতল জলে ডুবিয়া গিয়াছে। অতি সংক্ষেপে—নাট্যগরিমায়, পর পর কৌতূহলপদ প্রাণোন্মাদী দৃশ্যপরিবর্ত্তনে, নায়ক-নায়িকা অপূর্ব্বভাবে কবিত্ব ও ত্যাগমহিমা-মণ্ডিত হইয়া উঠিয়াছেন। ইঁহারা মুক্ত গগনের, সীমাবিহীন পথের পথিক—মহার্ণবে ডুবন্ত নৌকার নিমজ্‌জমান আরোহী যেরূপ ধ্রুবনক্ষত্রের প্রতি বদ্ধদৃষ্টি, সেইরূপ পরস্পরের মুখের দিকে চাহিয়া পৃথিবীকে অগ্রাহ্য করিয়া স্বর্গীয় পণে অটল। ইন্দুমতীর ন্যায় প্রেম-পারিজাত-স্পর্শে ইঁহারা প্রাণত্যাগ করিয়াও অমর হইয়াছেন। ইঁহারা কোন গৃহের সম্পর্কিত নহেন, ইঁহারা পরস্পরের প্রতি উদ্দাম অনুরাগ ভিন্ন অন্য কোন বিধি মানেন নাই,—প্রেম ভিন্ন ইঁহাদের ধর্ম্ম নাই,—পরস্পরের সাহচর্য্য ভিন্ন ইঁহারা কোন গৃহসুখ কল্পনা করেন নাই। ময়নামতীর গানে বর্ণিত আছে, রাজা গোপীচন্দ্রের অনেক স্ত্রী ছিলেন; তাঁহার সন্ন্যাসের পরে তাঁহারা সকলেই নূতন রাজা খেতুর গৃহে গমন করিয়া নবদাম্পত্যের অভিনয় করিলেন। ইহাতে অবশ্য কোন দোষের কারণ নাই। সেকালে রাজপ্রাসাদের ইহাই স্থানীয় প্রথা ছিল। একমাত্র অদুনা ঘৃণার সহিত সেই রীতি পদপলনপূর্ব্বক গোপীচন্দ্রের প্রতি একনিষ্ঠ হইয়া রহিলেন। এই অদুনা আমাদের গাতিকাগুলির নায়িকাদের সঙ্গে এক পর্য্যায়ে বসিবার যোগ্যা।


৬। গাথাসাহিত্যে উর্দ্দু প্রভাব—হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে প্রীতির ভাব

 এই নিরক্ষর কবিগণ সরল বাঙ্গালা কথায় উদ্দীপনার ছন্দে তাঁহাদের গাতি গাহিয়া গিয়াছেন। এই সকল গানে কতকগুলি উর্দ্দু শব্দ আছে, তাহাতে আমাদের আপত্তি করিবার কোন কারণ নাই। গত পাঁচ-ছয় শত বৎসরের মধ্যে বাঙ্গালা ভাষাটা হিন্দু ও মুসলমান