পাতা:মৈমনসিংহ গীতিকা (প্রথম খণ্ড) - দীনেশচন্দ্র সেন.pdf/২৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
ভূমিকা
১৴৹

উভয়েরই হইয়া গিয়াছে। মুসলমানদের ধর্ম্মশাস্ত্র ও সামাজিক আদর্শ অনেকটা আর্‌বি ও পার্‌সি সাহিত্যে লিপিবদ্ধ, সেই সাহিত্যের জ্ঞান তাঁহাদের নিত্যকর্ম্মের জন্য অপরিহার্য্য। আমাদের যেরূপ সংস্কৃতের সহিত সম্বন্ধ, আর্‌বি ও পার্‌সির সঙ্গে তাঁহাদেরও কতকটা তাই। তাহা ছাড়া মুসলমান এ পর্য্যন্ত রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন, সুতরাং নানা কারণে, বাঙ্গালা প্রাকৃতের সঙ্গে কতকটা উর্দ্দুর সংস্রব ঘটিয়াছে। মুসলমান আমাদের প্রতিবাসী, আমাদিগের কিছুতেই তাহাদিগকে এড়াইয়া যাওয়া সম্ভবপর নহে। এইজন্য ভারতের অব্যবহিত পশ্চিমদেশের ভাষা বাঙ্গালা ভাষার সঙ্গে কতক পরিমাণে মিশিয়া গিয়াছে এবং তাহা আমাদের নিত্যকথিত ভাষার অঙ্গীয় হইয়া উঠিয়াছে। এই মিশ্রভাষা আমাদের চাষার কুটীরে, এমন কি হিন্দুর অন্তঃপুরে পর্য্যন্ত ঢুকিয়াছে। বাঙ্গালার অভিধান হইতে এখন আর তাহা বাদ দেওয়া চলে না।

 কিন্তু হিন্দু লেখকগণ মুখে যে সকল কথা কহিয়া থাকেন, সংস্কৃতের ঘোর প্রভাবের বশবর্তী হইয়া লিখিবার সময় সেগুলি অন্যরূপ করিয়া ফেলেন। শতবার কথিত ও শ্রুত ‘খাজনা’ তাঁহাদের লেখনীতে ‘রাজস্ব’রূপে পরিণত হয়—চিরপরিচিত ‘ইজ্‌জৎ’ ‘সম্মান’ হইয়া দাঁড়ায়। এইভাবে ‘জবরদস্তি’ ‘বলপ্রয়োগে’, ‘দুস্তি’ ‘বান্ধবতায়’, ‘জমি’ ‘মৃত্তিকায়’, ‘আসমান ‘আকাশে’ এবং আরও শত শত নিত্যকথিত বিদেশী শব্দ, যাহাদের অস্থিমজ্জা বাঙ্গালার জলবায়ুতে দেশীয় রূপ ধারণ করিয়াছে, তাহারা লিখিত সাহিত্যে সংস্কৃত আগন্তুকের নিকট নিজেদের স্থান ছাড়িয়া দিতে বাধ্য হইয়া থাকে। এক সময়ে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের পণ্ডিতগণ অতিকায় সংস্কৃত শব্দ বাঙ্গালা সাহিত্যে আমদানী করিয়া এই ভাষার পর্ণ কুটীরটিকে ঐরাবতশালায় পরিণত করিয়া হাস্যাস্পদ হইয়া পড়িয়াছিলেন। সেই ভাবে আর্‌বি-পার্‌সির পণ্ডিতগণ উক্ত দুই ভাষার অপর্য্যাপ্ত ও অবৈধ শব্দ প্রয়োগ দ্বারা এখনও মুসলমানী বাঙ্গালা নামক একটা উদ্ভট সামগ্রীর সৃষ্টি করিতেছেন। বস্তুতঃ মুসলমানী বাঙ্গালা ও পণ্ডিতী বাঙ্গালা, ইহাদের কোনটাই বাঙ্গালার স্বরূপ নহে, উহারা আমাদের ভাষার বিদ্রূপ ও একান্ত পরিহার্য্য। ভাষা জিনিষটা পণ্ডিত বা মোল্লার হাতের মোরব্বা নহে। দেশের জলবায়ু ও আলোকে ইহা পুষ্ট হইয়া থাকে। ইহা স্বীয় জীবন্ত গতির পথে, ইচ্ছাক্রমে বর্জন ও গ্রহণ করিয়া চলিয়া যায়, স্বীয় ললাটলিপিতে কোন শিক্ষকের ছাপ মারিয়া পরিচিত হইতে চায় না।

 মৈমনসিংহ-গীতিকায় আমরা বাঙ্গালা ভাষার স্বরূপটি পাইতেছি। বহুশতাব্দীকাল পাশাপাশি বাস করার ফলে হিন্দু ও মুসলমানের ভাষা এক সাধারণ সম্পত্তি হইয়া দাঁড়াইয়াছে। ইহা সমস্ত বঙ্গবাসীর ভাষা। এক্ষেত্রে জাতিভেদ নাই। এই মৈমনসিংহ-গীতিকায় উর্দ্দু উপাদান ততটা ঢুকিয়াছে, যতটা প্রকৃত পক্ষে এদেশে আসিয়া বাঙ্গালা হইয়া গিয়াছে। এই

C—1918 B. T.