পাতা:মৈমনসিংহ গীতিকা (প্রথম খণ্ড) - দীনেশচন্দ্র সেন.pdf/২৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১৵৹
মৈমনসিংহ-গীতিকা

গীতিসাহিত্য হিন্দু-মুসলমান উভয়ের, এখানে পণ্ডিতগণের রক্তচক্ষে শাসাইবার কিছু নাই। লেখকদের মধ্যে হিন্দুও যতটি মুসলমানও ততটি। এই সাহিত্যে আবার হিন্দু নায়ক, মুসলমান নায়িকা এবং মুসলমান নায়ক ও হিন্দু নায়িকা পাইতেছি। প্রকৃত ঘটনা কবিরা যাহা শুনিয়াছেন, তাহাই অনেক সময়ে লিপিবদ্ধ করিয়াছেন। হিন্দুর ঘরে স্বাধীন প্রেম-চর্চ্চার সুযোগের অভাব অনুভব করিয়া বঙ্কিমচন্দ্র মুসলমানী আয়েষার আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছিলেন। তাহা মুসলমান-বিদ্বেষের ফল নহে। ইংরাজী উপাখ্যানের পূর্ব্বরাগ বাঙ্গালা সাহিত্যে আমদানী করিতেই হইবে, সুতরাং এক দিকে সমস্ত সমাজবন্ধন-বিচ্যুতা কপালকুণ্ডলারূপ অভূতপূর্ব্ব চরিত্র পরিকল্পিত হইয়াছে, অন্য দিকে মুসলমান সমাজ হইতে আয়েষাকে সংগ্রহ করিয়া লেখকের প্রাণের কামনা মিটাইতে হইয়াছে। বঙ্কিমবাবু নিজের সুবিধার জন্য সাহিত্যে এই চরিত্রগুলি সৃষ্টি করিয়াছিলেন। মুসলমানেরা কিন্তু জাতিগত বিদ্বেষের চিহ্ন বলিয়া এই ব্যাপারটা ধরিয়া লইয়াছেন। এটি মোটেই তাহাদের ভাল লাগে নাই। আজকাল অনেক মুসলমান লেখক বঙ্কিমবাবুর এই কার্য্যের প্রতিশোধ লইতে গিয়া হিন্দু রমণীকে মুসলমান নায়কের অনুরাগিণী করিয়া দেখাইতেছেন। কিন্তু মৈমনসিংহের গীতিকায়, সেইরূপ আড়াআড়ির ভাব, বা জাতীয় বিদ্বেষের চিহ্নমাত্র দেখিতে পাই না। মুসলমান কবি কালিদাস গজদানী এবং মমিনা খাতুনের প্রেম অকুণ্ঠিতভাবে বর্ণনা করিয়াছেন, পার্শ্বেই আবার ঈশাখাঁর প্রতি অনুরক্তা কেদার রায়ের ভগিনীর চিত্রটি আছে। আর-একটি গাথায় ব্রাহ্মণ জয়চন্দ্র এক মুসলমানীর প্রেমে পড়িয়াছেন ও অপর-একটিতে সুরৎজমাল ও ব্রাহ্মণ রাজকন্যা অধুয়ার প্রেমপ্রসঙ্গ আছে। এই সকল পালাগানের শ্রোতা হিন্দু-মুসলমান উভয়েই। হৃদয়ের কোমল বৃত্তিগুলির উপর যে দেবতা হাসিয়া খেলিয়া ফুলশর সন্ধান করিয়া থাকেন, তিনি হিন্দুর পরিকল্পিত হইলেও আদবেই জাতিভেদ স্বীকার করেন না। এই গাথাগুলিতে জাতীয় বিদ্বেষের কণিকামাত্র নাই, সত্য ঘটনা স্বকীয় গৌরবের বেদীর উপর দাঁড়াইয়া শ্রোতার অনুরাগ আকর্ষণ করিতেছে।

 হিন্দু ও মুসলমান যে বহুশতাব্দীকাল পরস্পরের সহিত প্রীতির সম্পর্কে আবদ্ধ হইয়া বাস করিতেছিলেন, এই গীতিগুলিতে তাহার অকাট্য প্রমাণ আছে। দেওয়ান সাহেবদের অত্যাচারের কথা অনেক স্থলেই পাওয়া যাইবে, কিন্তু তাহা ‘মুসলমানী অত্যাচার’ বলিয়া অভিহিত করা অন্যায় হইবে। এই অত্যাচার দুর্ব্বলের উপর প্রবলের অত্যাচার, ব্যভিচারীর ব্যভিচার,—ইহার জন্য কোন রাষ্ট্রীয় নাম দেওয়া যায় না, ইহা হিন্দু-মুসলমানের ধর্ম্ম বা জাতিঘটিত কোন ঘটনা নহে। এক দিকে দেওয়ান জাহাঙ্গীর যেরূপ মলুয়ার উপর অত্যাচার করিতেছেন, তেমনি বিচার না করিয়াই মুসলমান কাজীকে শূলে চড়াইয়া দিতেছেন। এক দিকে দেওয়ান ভাবনা সোনাইকে জোর করিয়া লইয়া যাইতেছেন, অপর দিকে সোনাইয়ের