পাতা:মৈমনসিংহ গীতিকা (প্রথম খণ্ড) - দীনেশচন্দ্র সেন.pdf/২৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
ভূমিকা
১৶৹

মাতুল ব্রাহ্মণকুলগৌরব ভাটুক ঠাকুর তাঁহাকে সাহায্য করিতেছেন। এক দিকে যেরূপ অত্যাচারী কাজী, দেওয়ান জাহাঙ্গীর, দেওয়ান ভাবনা,—অপর দিকে তেমনি বিশ্বাসঘাতক অত্যাচারী পরস্ত্রীলিপ্সু হিন্দুকুলতিলক হীরণসাধু ও মগাধিপতি রাংচাপুরের আবু রাজার নির্ম্মম মূর্ত্তি আমরা দেখিতে পাই। বস্তুতঃ সে যুগে প্রবলের অত্যাচার সর্ব্বত্রই ছিল। যদি রাজা ভাল হইতেন, তবে প্রজার সুখের সীমা থাকিত না। সোণার ভাটা লইয়া রাইয়তের ছেলেরা খেলিতে থাকিত, কলার পাতা বেচিয়া লোকে পাকা বাড়ী তুলিত, ঘাস-বেচা লোকে হাতী কিনিতে সাধ করিত, লোকে ধনকড়ি যেখানে সেখানে শুকাইতে দিত, ধনরত্ন পথে ফেলিয়া রাখিলেও চোরদস্যুর উপদ্রব থাকিত না। আবার রাজা কি মন্ত্রী অত্যাচারী হইলে রাইয়তেরা তাহাদের বলীবর্দ্দ, লাঙ্গল-জোয়াল এবং ফাল বিক্রয় করিয়াও ত্রাণ পাইত না, অতিরিক্ত খাজনার দায়ে দুধের ছেলেকে বিক্রয় করিত। বানিয়াচঙ্গের অত্যাচারী দেওয়ান দুলালের কারাগৃহ হইতে সিংহলরাজ্যের কারাগার অল্প ক্রূর বলিয়া বর্ণিত হয় নাই। সুতরাং এই দুর্ব্বলের উৎপীড়ন ইতিহাসবিশ্রুত সনাতন ঘটনা, হিন্দু বা মুসলমানের নামাঙ্কিত করিয়া ইহা জাতিবিদ্বেষ উস্‌কাইয়া দেওয়াব উপলক্ষ করা উচিত নহে। মুসলমান রাজত্বে মুসলমানের হাতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা বেশী ছিল, এইজন্য হয়ত অত্যাচারীর সংখ্যা তাহাদের মধ্যে বেশী ছিল,—কিন্তু সে দোষ ক্ষমতার কোন শ্রেণীবিশেষের নহে। বিজয় গুপ্তের পদ্মা-পুরাণে দেখিতে পাওয়া যায়, এক দিকে অত্যাচারী মুসলমান ব্রাহ্মণের কণ্ঠ হইতে পৈতা কাড়িয়া লইয়া তাহার মুখে থু থু দিতেছে, অপর দিকে হিন্দু গোপের। মুসলমান কাজীর দাড়ি উপড়াইয়া তাহার মুখে ছাগের রক্ত মাখিয়া দিতেছে, সুতরাং কেহই কম নহে।

 বাঙ্গালা ভাষাটা প্রাকৃতের রূপভেদ। কিন্তু টোলের পণ্ডিতেরা এই ভাষায় অপর্য্যাপ্ত সংস্কৃত শব্দ আনয়ন করিয়া ইহার শ্রী বদ্‌লাইয়া দিয়াছেন; এইজন্য কাহারও কাহারও মনে হইতে পারে, বাঙ্গালা ভাষা সংস্কৃত হইতে উদ্ভূত হইয়াছে। সংস্কৃত যুগের পূর্ব্ব সাহিত্য, বিশেষ এই গীতিকাগুলি, পাঠ করিলে যে ভুল ঘুচিয়া যাইবে। খাঁটি বাঙ্গালা যে প্রাকৃতের কত নিকট ও সংস্কৃত হইতে কত দূরবর্ত্তী তাহা স্পষ্টভাবে হৃদয়ঙ্গম হইবে। এই সকল গাথায় ‘হস্তী’ (হাতী) শব্দ ‘আত্তি’, ‘বর্ষা’ শব্দ ‘বাস্যা’, ‘শ্রাবণ’ শব্দ ‘শাওন’, ‘মিষ্ট’ শব্দ ‘মিডা’, ‘শিকার’ শব্দ ‘শিগার’ প্রভৃতি প্রাকৃত ভাবেই সর্বদা ব্যবহৃত হইয়াছে। এখনও চাষারা এই ভাষায় পাড়াগাঁয়ে কথা কহিয়া থাকে। পণ্ডিত মহাশয়ের টোলে ঘুরিয়া আমাদের মাথা ঘোলাইয়া গিয়াছে; আমরা অভিধানের সাহায্যে প্রাকৃতশব্দ সংশোধনপূর্বক সেই সংশোধিত ভাষাটাকেই বাঙ্গালা ভাষা বলিয়া পরিচয় দিতেছি। এই সংশোধন-কার্য ভারতচন্দ্র এমন কৌশলের সঙ্গে চালাইয়াছিলেন যে, তাঁহার রচিত কয়েকটি বাঙ্গালা স্তোত্র নাগরী অক্ষরে লিখিলে তাহা নিছক সংস্কৃত বলিয়া গৃহীত হইতে পারে।